শতবর্ষী ফিরোজা বেগমের শেষ ইচ্ছা ছেলে হত্যার বিচার!

প্রকাশিত: ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১

নিউজটি শেয়ার করুন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল : যারা হত্যায় অংশ নিয়েছেন সময়ের পালাবদলে তাদের মধ্যে একজন চলমান পৌর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী। সাবেক চেয়ারম্যান একজন; এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতিও আছেন। তাদের বিচার চেয়ে দিনের পর দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে, আদালতে অপেক্ষা করে ক্লান্ত শতবর্ষী ফিরোজা বেগম।

 

জীবনের শেষ কোন ইচ্ছে নেই অশতিপর এই বৃদ্ধার। শুধু ছেলে হত্যার বিচারের খবরটা শুনে মারা যেতে চান। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব ফিরোজার কথা স্পষ্ট নয়, স্বর আটকে যায় ছেলে জাসদ নেতা সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের কথা মনে উঠলে। মুর্ছা গিয়ে পরে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু আজ বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে বিচার চাইতে এসেছিলেন মৃতপ্রায় ফিরোজা। ‘আমার চউখে (চোখে) পঁচন ধরছে, আমার বাবার খুনের বিচার চাইয়া (চেয়ে) কাঁনতে-কাঁনতে (কান্না)। গেদু আমার শ্যাষ ইচ্ছা, আমার পোলার (পুত্র) খুনির বিচারের খবরডা হুইন্যা মরমু।’

 

নিহত সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের পরিবারের উদ্যোগে বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায় শহীদ মিনার চত্বরে আয়োজিত মানবন্ধনে এসব কথা বলেন ফিরোজা বেগম। দীর্ঘ সাত বছরে ধরে এভাবেই বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন জনের কাছে ছেলে হত্যার জন্য কেঁদে আসছেন ফিরোজা ও তার পরিবার।

 

নিহত সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের ভাই সৈয়দ তরিকুল ইসলাম আপনুর বলেন, কোন বিরোধ ছাড়াই আমার ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে মিন্টু, টুকু, সালাম, রঞ্জু, ফিরোজ। আমার ভাই সৎ মানুষ ছিলেন। রাজনীতি করে অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন উপজেলা জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। খুনিরা প্রতিহিংসার কারনে রোজাদার সৈয়দ হুমায়ূন কবিরকে জুমার নামাজের আগে কুপিয়ে হত্যা করে পথের কাটা দূর করেছিল।

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, জিয়াউল হক মিন্টু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। নৌকা মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে শুনেছি। আরেক খুনি মজিবুল ইসলাম টুকু চাখার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। খুনি ছালাম হাওলাদার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাকি খুনিরাও এদের ছত্রছায়ায় আছেন। চার্জশিটে এরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু জামিন নিয়ে এসে আমাদের আবারও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচার পাবো কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছি। সৈয়দ তরিকুল ইসলাম বলেন, ওরা আওয়ামী লীগের লোক না। ওরা খুনি। ওদের ফাঁসি চাই।

 

মামলার আইনজীবী আনিচুর রহমান বলেন, মামলা পরিচালনা করি বলে ক্ষমতাশীন এইসব খুনিরা আমার পরিবারকেও হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে যেন মামলায় লড়াই না করি। হত্যাকারিরা জানে মামলা শেষ পর্যন্ত গেলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।

 

আনিচুর রহমান আরো বলেন, আমরা চাই ক্ষমতার মুখোশে থাকা এইসব খুনিদের ফাঁসি হোক। একই সাথে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো আসামীদের জামিন বাতিল করে গ্রেফতার করার দাবী জানান তিনি।

 

মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মামলার স্বাক্ষী মো.জাফর আলী, নিহতের বোন আইনুন নেছা, আক্তারুন নেছা, ভাই সৈয়দ কায়কোবাদ।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সৈয়দ হুমায়ুন কবির উপজেলার মাদারকাঠী গ্রামের বাড়ি থেকে রোজাদার অবস্থায় চাখার ওয়াজেদ মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার সময় তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চাখার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মজিবুল ইসলাম টুকুর মাদরকাঠী বাসস্ট্যান্ড মার্কেটের নিচতলায় আটকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

 

মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, বর্তমান মেয়র প্রার্থী জিয়াউল হক মিন্টুর নেতৃত্বে ওই মার্কেটে আটকে দা, হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। খুনিরা সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের পায়ের ও হাতের রগ কেটে দেন। হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে, অন্ডকোষ থেতলে, মাথায় উপুর্যপরি কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করেন। খবর পেয়ে স্বজনরা চেয়ারম্যান টুকুর মার্কেট থেকে আহত হুমায়ূনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।

 

পরদিন ২০ জানুয়ারী (শনিবার) সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই সৈয়দ তরিকুল ইসলাম আপনুর বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) সনজিৎ কুমার ওই বছরের ২৩ অক্টোবর জিয়াউল হক মিন্টু, মজিবুল ইসলাম টুকু, আব্দুস সালাম, রঞ্জু, ফিরোজসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিল করেণ। আদালতে এ পর্যন্ত মামলার ২৭ জনের স্বাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে।


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ