দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুট: ১৮ মাসে অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক প্রাণহানি

প্রকাশিত: ৯:১২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩, ২০২৩

দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুট: ১৮ মাসে অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক প্রাণহানি
নিউজটি শেয়ার করুন

 

২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪১ জন নিহত হন। বিশ্বে এমন আকস্মিক ও ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড বিরল। তার ঠিক ১৬ মাসের ব্যবধানে ২০২৩ সালের ১১ মে কীর্তনখোলা নদীতে নোঙর করে রাখা তেলবাহী এমটি এবাদী-১ জাহাজের বিস্ফোরণে পিতা-পুত্রসহ ৬ জন মারা যান।

 

 

এ ঘটনার ৫২ দিনের পর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে নোঙর করে রাখা সাগর নন্দিনি-২ তেলবাহী জাহাজে আরেক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত হৃদয় নামে একজন শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ রয়েছে আরও তিনজন। উদ্ধারকারী সংস্থা মনে করছে, নিখোঁজ সবাই মারা গেছেন। এছাড়া দগ্ধদেরও অবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। সাগর নন্দিনি-২ এর আগে ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভোলার মেঘনা নদীতে অপর একটি নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে গিয়েছিল।

 

 

বিগত ১৮ মাসে বরিশাল বিভাগের কীর্তনখোলা ও সুগন্ধা নদীতে একই ধরণের তিনটি ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারালেন। এ রুটে আগে নৌযান ডুবির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি থাকলেও এক দশকে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রচেষ্টায় তা হ্রাস পেয়েছে। তবে যাতায়াতের প্রাচীন এ রুটে হঠাৎ করেই বেড়েছে অগ্নিদুর্ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে চলন্ত অথবা নোঙর করে রাখা নৌযানে বিস্ফোরণ ঘটছে কেন?

 

 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল অধ্যায়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক মনে করেন, পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো সঠিকভাবে কাজ না করায় একের পর এক যান্ত্রিক বিপর্যয় হচ্ছে। দেশে নৌযানগুলোকে যারা চলাচলের সনদ দেন, তারা প্রভাবিত হয়ে এসব যানবাহনের অনুমতি দেন নয়তো তারা যান্ত্রিক বিষয়গুলো নিয়ে অতটা দক্ষ নন।

 

 

এ দুর্যোগ পর্যবেক্ষকের মতে, বিস্ফোরণ সাধারণত অক্সিজেন, জ্বালানি-ইবিয়েশন বা আগুনের উৎস-এ তিনটির সমন্বয়ে ঘটে থাকে। অভিযান-১০ লঞ্চ, এমটি এবাদী-১ ও সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের পর্যালোচনায় এ তিনটি ঘটনার সম্মিলন পাওয়া যায়।

 

 

ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, আমাদের দেশে বড় বড় নৌযানগুলোর ইঞ্জিনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব ইঞ্জিনের একটি বৃহদাংশ অন্য দেশে ব্যবহৃত হওয়ার পরে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে এদেশের কোম্পানিগুলো কিনে আনে। ফলে ইঞ্জিনগুলোর লাইফটাইম যখন শেষ হয়ে যায়, তখন বিস্ফোরণের জন্য এগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

 

 

তিনি বলেন, দেশে আইন আছে, বড় বড় কথা আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। নৌযানে বিস্ফোরণ বা বিপর্যয় ঠেকাতে হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতরগুলোর তৎপরতা, সক্ষমতা ও পদ্ধতিগত প্রয়োগ আরও বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে যারা আইন প্রয়োগ করবেন তাদের সৎ হতে হবে।

 

 

 

পর্যবেক্ষণের ঘাটতির বিষয়টি জানিয়ে সাগর নন্দিনি-২ জাহাজে উদ্ধার অভিযান চালানো ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক ফিরোজ কুতুবী বলেন, ২৭ তারিখ নোঙর করার পর জাহাজ কর্তৃপক্ষ যদি সঠিক মনিটরিং করত তাহলে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটত না। ইঞ্জিনরুমের কার্বন মনোক্সাইড প্রতিদিন বাইরে নিঃসরণ করে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করানোর নিয়ম। কিন্তু চারদিন ইঞ্জিনরুমটি বন্ধ ছিল। যে কারণে এ শক্তিশালী বিস্ফোরণটি ঘটে।

 

 

 

শুধু জাহাজ কর্তৃপক্ষ নয় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের আরও নজরদারি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বরিশালের উপ-সহকারী পরিচালক বেলাল উদ্দিন। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ ও এমটি এবাদী-১ জাহাজে বিস্ফোরণে উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী এ কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, নির্ধারিত সময় পরপর নৌযানগুলো পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এসব নৌযানের ইঞ্জিন, কভার, ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যার, ফিটনেস এবং চলাচলে সঠিক নিয়ম মেনে চলে কিনা তাতে শিপিং কর্পোরেশনের তৎপর হওয়া উচিত এবং তাদের ম্যানটেনেহন্স বাড়ানো উচিত। অন্যথায় এমন দুর্ঘটনা হ্রাস করানো দুঃসাধ্য।

 

 

এ কর্মকর্তা বলেন, যেসব নৌযান অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তদন্তে সেগুলোর কোনো না কোনো ত্রুটি বের হচ্ছে। এ ত্রুটিগুলো আগে শনাক্ত হলেই কেবল দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। ত্রুটি শনাক্তে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো দরকার।

 

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করার কারণেই এ দুর্ঘটনাটি ঘটছে। ঝালকাঠিতে বিস্ফোরণের শিকার জাহাজটি কয়েকমাস আগেও ভোলায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। সেখান থেকে উদ্ধার করার পর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা যদি নৌযানটির সার্ভে করত, তাহলে ত্রুটি ধরা পড়ত। তা হয়েছে বলে মনে হয় না! সড়কেও যে গাড়িগুলো দুর্ঘটনায় কবলিত হচ্ছে, তদন্তে উঠে আসছে বিভিন্ন ত্রুটির কারণেই সেগুলো দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। এসব পরিবহন বা নৌযান যদি নিয়মিত চেকআপ করা হয় তাহলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে। কিন্তু তা করা হয় না। পাশাপাশি যাত্রী ও নৌযান শ্রমিকদের সচেতন হতে হবে।

 

 

 

পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে জাহাজ মালিকদের আরও সচেতনতা দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ফয়সাল কবির। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের একটি বড় কারণ এসব জাহাজে নিয়ম না মেনে আগুনের ব্যবহার করা। সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে দিয়েছে জ্বালানি বহনকারী জাহাজগুলোতে ধূমপান নিষিদ্ধ। ইঞ্জিনরুম নিরাপদ রাখতে শিপিং কর্পোরেশনের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলা। কিন্তু অনেক জাহাজেই তা হয়তো করে না।

 

 

তিনি বলেন, শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজগুলো আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করি। একইভাবে এসব কার্গো জাহাজগুলোও মালিকদের তদারকি করা উচিত।


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ