ঘুষের রেট ঠিক করে দিলেন নাজিরপুরের এসি ল্যান্ড

প্রকাশিত: ৩:৫৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩

ঘুষের রেট ঠিক করে দিলেন নাজিরপুরের এসি ল্যান্ড
নিউজটি শেয়ার করুন

 

জমি নামজারি করতে সরকারি ফি থেকে বেশি অর্থ নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক সহকারী কমিশনারের (এসি ল্যান্ড) বিরুদ্ধে।

 

 

অভিযুক্ত মাসুদুর রহমান বর্তমানে পিরোজপুররের নাজিরপুর উপজেলায় এসি ল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভূমি কর্মকর্তারা কোন রেটে ঘুষ গ্রহণ করবেন তা ঠিক করে দিয়েছেন। এমন একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

 

 

জানা যায়, জমি খারিজ বা নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি কার্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা দলিল ভেদে নেন ৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ নামজারির আবেদনের জন্য কোর্ট ফি ২০ টাকা, নোটিশ জারি ফি ৫০ টাকা, রেকর্ড সংশোধন বাহালকরণ ফি ১ হাজার টাকা ও প্রতি কপি মিউটেশন খতিয়ান সরবরাহ বাবদ ১০০ টাকার বাইরে আর কোনো খরচ নেই।

 

 

কোনো কারণে জমি হস্তান্তর হলে খতিয়ানে পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোকে বলে নামজারি। উত্তরাধিকার সূত্রে, বিক্রয়, দান, খাসজমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তান্তরের কারণে জমির মালিকানা বদল হয়। কিন্তু জমির নামজারি না করানো হলে মালিকানা দাবি করার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। জমি রেজিস্ট্রেশন, ক্রয়-বিক্রয়, খাজনা প্রদানসহ নানা ক্ষেত্রে নামজারি প্রয়োজন হয়। জমি হস্তান্তর হওয়ার পর নামজারি করা অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

 

নাজিরপুর উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে গত জুলাইয়ে বৈঠক করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) মাসুদুর রহমান। ওই বৈঠকের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। বৈঠকে তিনি ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এখন আমাকে পরিষ্কার করে একটি বিষয় আপনাদের অবগত করতে হবে। আমি ইউএনও স্যারের চাপে আছি। ধরেন আমার অফিস থেকে নামজারিতে অতিরিক্ত আদায় বন্ধ করা হলো। আপনারা পার কেইসে যে ডিল করেন। কিন্তু সেটা আপনারা নিশ্চিত করবেন কীভাবে যে টাকা নিচ্ছেন না। আপনাদের মতামত শুনি। আপনারা কী চান? কত করে নেওয়া হোক? খোলামেলা আলোচনা করেন, মতামত দেন, সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। যদি বলেন স্যার, আপনি যদি না করে দেন, তাহলে আমরা কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন করব না। কিন্তু বাস্তবে এটা কখনো হবে না। আপনারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই খরচা আছে এবং বিভিন্ন ধরনের বিষয় আছে। যেটার কারণে এটা নিতে হচ্ছে বা নিচ্ছেন। এটা কমবেশি সবাই নিচ্ছে। কিন্তু এই অফিসে দেওয়া হচ্ছে বিধায় আপনারা এটাকে বড় আকারে একটা কিছু করবেন, এ ধরনের অভিযোগ সামনে এলে আমার জন্য তা বিব্রতকর।’

 

 

 

এক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কাছে এসি ল্যান্ড জানতে চান, ‘ধরেন একজনের দুই একর জমি আছে, তার কাছ থেকে নামজারির ক্ষেত্রে কত টাকা নেবেন? যেহেতু তার জমি বেশি, তার কাছ থেকে বেশি টাকা নেবেন, এ রকম।’

 

 

 

ওই ইউনিয়ন কর্মকর্তা বলেন, ‘সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।’ এ সময় বৈঠকে উপস্থিত আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে ৫ হাজার ছিল, আপনি অনুমতি দিলে এখন ৪ হাজার নিতে পারি। আপনি স্যার যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেইভাবে করব।’

 

 

 

এরপর এসি ল্যান্ড বলেন, ‘ধরেন আমি ৪ হাজার করে নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত করে ডিল করবেন। ক্লিয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনে কথাগুলো রেকর্ড থাকবে।’ তখন একজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বোচ্চ ৬-এর বেশি আমরা নেব না।’

 

 

 

এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আপনারা সঠিকভাবে বলেন, আপনারা কত টাকা করে নিতে চান। যে স্যার এই টাকা না হলে আমাদের আসলে চলবে না। আমি আমার দিক থেকে প্রস্তাব করব আপনারা সাড়ে ৫ হাজার করেনে। আমার এখানে ৪ হাজার দেবেন। আপনারা দেড় হাজার নেবেন।’

 

 

 

এরপর বৈঠকে উপস্থিত ইউনিয়ন পর্যায়ের সব কর্মকর্তা একমত হন দলিল প্রতি ৬ হাজার টাকা করে নেওয়ার। তখন এসি ল্যান্ড বলেন, ৬ হাজার মানে ৬ হাজারই। ৬ হাজার থেকে ১০০ টাকা বেশি হলে আমি ব্যবস্থা নেব। গত অর্থবছর পর্যন্ত যেগুলো ছিল, সেটা এ সপ্তাহের মধ্যে ক্লিয়ার করবেন। প্রতি মাস শেষ হওয়ার পর নতুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে হিসাব ক্লোজ করে রোববারের মধ্যে আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। জুলাই মাস শেষ হলে যত মামলার হিসাব হবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। এটা ক্লিয়ার করে পরের রোববার উপস্থাপন করবেন। এই হলো সামারি। এছাড়া একটা রেজিস্টার রাখবেন। যেটা ইন্টার্নাল ব্যবহারের জন্য।’

 

 

 

এসি ল্যান্ড মাসুদুর রহমান অস্বীকার করে বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। একটি চক্রান্তের শিকার হচ্ছি আমি। উপর মহল থেকে নির্দেশনা যেভাবে আসে আমি আসলে সেভাবে কাজ করে থাকি। কিন্তু কখনো কোনো আর্থিক বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কারো কথা হয়নি।

 

 

 

নাজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জীব দাশ বলেন, বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক স্যারকে জানানো হয়েছে। তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্তের পরে এ বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

 

 

পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, অডিওটি শুনেছি। এ ঘটনায় স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালককে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিবেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ