কীভাবে ভালোবাসবো?

প্রকাশিত: ৪:৫১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২৩

কীভাবে ভালোবাসবো?
নিউজটি শেয়ার করুন

 

 

সড়ক দুর্ঘটনায় আমার একটি পা হারিয়ে কোমা থেকে বের হলাম আজ দুই মাস পর। আত্মীয়-স্বজন সবাই আমাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যস্ত। মা-বাবা, ভাই,দাদু সবার আমাকে সুস্থ হতে দেখে যেনো তাদের মনে আনন্দের ফোয়ারাস্নাৎ বইছে। সবাই খুশি, সবার যেন আনন্দের সীমা নেই।

 

 

এ যেন পৃথিবীতে নতুন অতিথি আগমনের মতোই আনন্দ-উল্লাস। আমিও সবাইকে পুনরায় দেখে মহা খুশি,পা হারানোর দু:খ আমার মানসিকতাকে একদম ভেঙে দেয়নি আমার পরিবারের আমাকে পুনরায় পাওয়ায় সুখের উল্লাসেই। আমি শত মানুষের ভীড়ে তাকে খুঁজছিলাম দু’চোখের আঙিনায়।কিন্তু আমার চোখের সীমানায় তার অন্ত মিলাতে না পেরে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা…”ও কোথায়?ও আসেনি?” মা’সহ সব আত্মীয়দের বক্তব্যতে আমার জীবনের প্রতি ঘৃণা হতে লাগলো।

 

 

 

সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের পা হারিয়েছি বলেই সে আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। পারিবারিক সম্মতিতে আমাদের বিয়েও ঠিক হয়েছিলো।বিয়ের ছয় দিন আগে আমরা শপিং এ বের হয়েছিলাম। হাসি, আনন্দ আমাদের নাগাল অনাতীক্রম আর ভালোবাসায় দুইজনে বাইকে করে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ একটা বাস এসে পড়ে আমাদের সামনে।তারপরে আমার আর কিছুই মনে নেই।আজ মনে হচ্ছে আমি সেদিন কেন মারা গেলাম না।এর থেকে মৃত্যু শ্রেয় নয়কি?ভালোবাসার মানুষটা আমার এই পায়ের জন্য ছেড়ে গেলো অথচ ওর বাইকেই আজ আমার এই অবস্থা। ঘৃণা আর ঘৃণায় নিজেকে বার বার শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছিলো।আমি তো মৃতই প্রায়,ছয় বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক আমাদের।যে আমার পঙ্গুত্বটাই মেনে নিতে পারলো না সে কেমন ভালোবাসতো বুঝতে বাকি রইলো না।

 

 

 

আমি আর কখনো ওর সাথে দেখাই করিনি,ইচ্ছাটাও জাগেনি। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর পরে আজ আমি অন্য কারো ঘরের বউ।বাবা-মায়ের আকুতি মিনতিতে অমত করতে পারিনি। পঙ্গুত্ব মেনে নিলো আমার মায়ের খালাতো ভাইয়ের ছেলে। আমার ফুটফুটে ছোট একটা মেয়েও আছে।ওর বয়স এক বছর।আজ আমার মেয়ে সেজুতির জন্মদিন। বাড়িতে অনুষ্ঠানের ধুম পড়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বিকালে সবাই চলে গেলো। সেজুতি ঘুমিয়ে আছে।সোহাগ মেয়ে অন্তপ্রাণ সে মেয়েকে চোখের আড়াল করে না।মেয়েটার পাশে সেও ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি আর মা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প করছি।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, হিমেল ঠান্ডা হাওয়াতে আমার অনেক আনন্দ অনুভব হচ্ছে। চা খেতে খেতে মা বলে উঠলো, “জানিস! আমি সব থেকে বেশি কাকে ভালোবাসি?” আমি জানতাম আমাকেই ভালোবাসে।

 

 

 

তবুও কৌতুহল বশত বলে উঠলাম কাকে?আম্মু আমার কথাই বললো। পরোক্ষণে আম্মু জিজ্ঞেস করলো তুই কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসিস? আমি বললাম সেজুতিকে। আম্মু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো সব থেকে বেশি ঘৃণা করিস কাকে? আমি হঠাৎ বৃষ্টির মাঝেই হারিয়ে গেলাম। আম্মু বলে উঠলো কি উত্তর দিলি না যে? বিস্মিত কন্ঠস্বরেকে চাপা দিয়ে হাসির ছলেই বলে উঠলাম মা জানোই তো আমার সব থেকে বেশি ঘৃণা কাকে।ওর জন্য আজ আমি হুইলচেয়ারে, আর ও অন্য কাউকে আমার স্থান দিয়েছে।

 

 

 

আমার প্রতিটা দিন ওর প্রতি অসীম ঘৃণা দিয়েই কাটুক তাই চাই। ওর নামটাও আমার মুখে আনতে চাই না।চাইনা ওর স্মৃতিচারণ। সুনায়না আজ তোকে একটা সত্য কথা বলতে চাই বল তুই রাগ করবি না? মায়ের এ কথা শুনে বললাম কি কথা বলো…! মা বললো সেদিন সাকিব কাউকে বিয়ে করেনি না কাউকে নিয়ে সংসার পেতেছে বরং….. বরং কি মা? মা তুমি থেমে গেলে কেনো? মা বলো? তোর সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা তোকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারলেও সেদিন সাকিবকে নিয়ে আসার সময়টাও দেয়নি আল্লাহ আমাদের । সেদিন সাকিব ওইখানেই মারা যায়। কথাগুলো লুকিয়ে ছিলাম শুধু তুই সহ্য করতে পারবি না বলে।আমায় ক্ষমা করে দে মা।

 

 

 

আমার চারিদিকে ঘন মেঘে আচ্ছাদিত,চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেলো,স্তব্ধ হয়ে গেলো আমার বিকাল। বারংবার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিলো,ভুল বুঝেছিলাম! যাকে এতগুলো বছর ভুল বুঝে ঘৃণার পাহাড় জমালাম, আজ আবার তাকে নতুন করে কীভাবে ভালোবাসবো!

 

লেখকঃ তানজিলা আক্তার 


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ