ঢাকা ৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৫৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩, ২০২১
সুজন মোল্লা, বানারীপাড়া: জীবন যে, কতো কঠিন তা বুজতে হলে দেখতে হবে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার অতি সাধারণ ও সোজা-সাপটা প্রকৃতির রহিমা বেগম (৬৫) কে।
এই প্রতিবেদকের সাথে রাস্তায় কথা হয় রহিমা বেগমের। বলছিলেন বাবা আমি চোখে তেমন দেখতে পাইনা। শরীরটাও আজকাল আর ভালো নেই। গা কাঁপছে। আপনি বিমল সাহার দোকানে আসেন যা জানতে চান সেখানেই বলবো।
তার কথামতো পিছন পিছন গিয়ে দোকানে হাজির হলাম। একে একে জানালেন তার জীবন কাহিনী। যেদিন তিনি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন সেদিনই তার মা আছিয়া বেগম মারা যান। তার কয়েক বছর পরে পিতাও চলে যান পরপারে। পিতা-মাতার সংসারে একাই ছিলেন রহিমা বেগম। পরে ফুপুদের বাড়িতে থাকতে হয় তাকে।
একটু বড় হবার পরেই কিশোরী বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন তারা। স্বামী হাসেম বেপারী। বিবাহের কয়েক বছর পেড়িয়ে গেলেও যখন রহিমা বেগমের কোল জুড়ে কোন সন্তান আসেনি। তখন তিনি আল্লাহর কাছে মানত করেন, একটি ছেলে সন্তান হলে তার নামের সাথে মিল করে রহিম নাম রাখবেন।
মহান মালিক যেন, তার ফরিয়াদ কবুল করেছিলেন। সংসারের আলো হয়ে আসে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। নাম রাখেন রহিম বেপারী। তবে সন্তান ভূমিষ্টের কিছু দিনের মধ্যেই স্বামী হাসেম বেপারীও চলেযান তাদেরকে ছেড়ে। তখন রহিমা বেগমের চোখে-মুখে নেমে আসে অমানিষার ঘোর অন্ধকার।
মনের ভিতরে কেবলই ভাবনা ছিলো কিভাবে চলবে সংসার। দুনিয়াতেতো আপন বলতে তার আর কেউই রইলোনা। সংসার নামক শব্দটি তাকে যেন প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াতে লাগলো।
কি করবে কোথায় যাবে। এক সময় বাধ্য হয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কাপড়ের খোটে সন্তানকে বেঁধে নেমে পড়েন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করার জন্য।
তবে সন্তানের জন্য কোন বাড়িতেই ঠিকমতো বেশিদিন কাজ করতে পারতেন না তিনি। তবুও বেঁচে থাকার চেষ্টায় মালকিনদের হাতে-পায়ে ধরে আকুতি-মিনতি ছিলো তাকে যেন, কাজ থেকে তাড়িয়ে না দেয়।
রহিম আস্তে আস্তে বড় হয়। সেও মায়েরমতো সোজা-সাপটা প্রকৃতির। একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে প্লাষ্টিকের হরেক রকমের মাল (যা নিবেন ১০টাকা) ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাতে কি হবে সরল হওয়ায় কিছুদিন যাবার পরে ব্যবসার মূলধন শেষ হয়ে যায় তার।
এ কারনে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপরে রহিমা বেগম বৃদ্ধ বয়সে বানারীপাড়া পৌরসভার একজনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো কেবলমাত্র তার সেবা করার জন্য আর ছেলেকে নিয়ে দুমুঠো খাবার আশায়।
সেও ১ বছরের মাথায় পরপারের যাত্রী হন। জন্ম থেকেই যেন, রহিমার ভাগ্যটাই প্রসন্ন ছিলোনা। দুঃখ আর কষ্ট তার জীবনের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো।
ছেলের স্ত্রী চলে যাবার পরে সেও কোথায় যেন চলে গেছে। কোন খোঁজ-খবর নেই তার। তবুও এনজিওর অফিসার মাঝে মাঝে আসেন রহিমা বেগমের কাছে,আপনার ছেলের কাছে এতো টাকা পাবো কে দেবে। আসলেইতো তাই কে দেবে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রহিমা বেগম চোখের আলো হারিয়ে এখন বানারীপাড়া পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের বন্দর বাজারে সাহা মিষ্টান্ন এন্ড রেস্টুরেন্টে একদিন পর একদিন ১০/১২ কলস পানি দিয়ে মজুরি হিসেবে পান ৬০টাকা। তবে দোকানের মালিক তাকে দেন ৮০টাকা ।
এই টাকা দিয়ে উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের খেজুরবাড়ি আবাসনের ৪০নং ব্রাকে একজনকে ১হাজার টাকা দিয়ে ৩০দিনের পেটের ক্ষুধা মেটান হতভাগ্য রহিমা বেগম। ১ মাসে ১ হাজার টাকায় কিবা খেতে পারছেন রহিমা বেগম।
তা সবারই জানা। তবুও পেটেতো কিছু গেলো এই অভিনয় শালায় বসবাস ও বেঁচে থাকার জন্য। রাত্রি যাপনও করেন সেখানেই। চোখে দেখতে পাননা তবে কিভাবে দোকানে পানি দিচ্ছেন।
এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে জানালেন আগের চেনাপথ মনের ভিতর থেকে খুঁজে নিয়েই ছুটে চলছি বেঁচে থাকার তাগিদে। কথা হয় সাহা মিষ্টান্ন এন্ড রেস্টুরেন্টের মালিক বিমল সাহার সাথে। তিনি বলেন, চোখে দেখেন না এটা সত্য। তার দোকানে একদিন পর একদিন পানি দেন তিনি।
বৃদ্ধ হওয়ার কারনে প্রতিদিন পানি দিতে পারেন না। যেদিন পানি দেন সেদিন দিক হারিয়ে অনত্র চলে যান। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন বিমল সাহার দোকান কোথায়। পানি আনেন ১নং ওয়ার্ডের জামে মসজিদ থেকে। তার দোকান থেকে প্রায় ২শত ফুট দূরত্ব হবে।
আবারও রহিমা বেগমের কাছে প্রশ্ন আপনার চোখের এমন অবস্থা কেমন করে হলো। কেঁদে দিলেন সাথে সাথে। সেই জন্ম থেকে যে কান্নার শুরু তার শেষতো আর হলোনা। আর কতোদিন দুটি চোখ এতো পানি ধরে রাখতে পারে। চোখের জন্য ডাক্তার দেখিয়েছেন।
ফ্রি ডাক্তার দেখিয়েছি অপারেশন করতে হবে বলেছেন। টাকা নেই তাই আর অপারেশনও হবেনা। যতদিন সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখবেন এমনি ভাবেই চলে যাবো। তবে বাবা আমার জন্য দোয়া করবেন, এই দুনিয়ায় আপন বলতে আমার আর কেউ নেই।
মরনের সাধতো গ্রহন করতেই হবে, তা যেন হঠাৎ করেই হয় এই প্রার্থনাই করছেন সর্বদা রহিমা বেগম। আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায় ছিলো জানালেন বাইশারী ইউনিয়নের নলশ্রী গ্রামে। তা বহু আগেই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী ভাতা পান। সেটা আবার কি? তার এখন দুটি চাওয়া একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই আর হঠাৎ একদিন চলে যাওয়া।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক