ঢাকা ৪ঠা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:০১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২
শিল্পীর তুলিতে বীর নারী ভাগীরথীকে হত্যার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
মহান মুক্তিযুদ্ধে জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনে হানাদারদের বিতাড়িত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন পিরোজপুরের এক নিভৃত গ্রামের গৃহবধূ ভাগীরথী সাহা। দিনটি ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। জেলা শহরের পিচঢালা পথে যেন আলপনা এঁকেছিল ভাগীরথীর তাজা রক্ত।
১৯৪০ সালে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামের মুড়ি বিক্রেতা বসন্ত সাহার ঘরে ভাগীরথীর জন্ম। আর্থিক অনটনের কারণে বাড়িতে অক্ষর জ্ঞান অর্জন ছাড়া লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তার। বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। স্বামী প্রিয়নাথ সাহার বয়স তখন চল্লিশ। তার বাড়ি পিরোজপুর সদর উপজেলার বাগমারায়। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে। ১৯৬৭ সালে প্রিয়নাথ সাহা মারা গেলে অসহায় হয়ে পড়েন ভাগীরথী। অনেক কষ্টে ছেলেদের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। একাত্তরের ৪ মে ৩২ পাঞ্জাবের এক প্লাটুন রক্তপিপাসু হায়না পিরোজপুরের কয়েকশ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
রাজাকার-আলবদর জামায়াত ও মুসলিম লীগের সমর্থকদের সহযোগিতায় হানাদাররা বাগমারা গ্রামের সব কটি বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে আবার মহাবিপদে পড়ে যান ভাগীরথী। উপায়ন্তর না দেখে পিরোজপুরে শহরে বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেন। প্রতিদিন সকালে তিনি নৌকায় শহরে এসে বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন। প্রতিদিন যাওয়া-আসার সময় তার চোখে পড়ে নদীতে ভাসমান মানুষের অনেক লাশ। নদীর পাড়ে শিয়াল-শকুনের ভক্ষণরত লাশও দেখতে পান তিনি। এসব দেখতে দেখতে পাকিস্তানিদের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ জন্মে। এক সময় তার মনে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের অগ্নিশিখা। সেই সময় বাগমারাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে।
১৩ আগস্ট সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৭ মুক্তিযোদ্ধা একপাই জুজখোলা গ্রামে অবস্থান নেন। পরে মতিউর রহমান সরদারের নেতৃত্বাধীন আরেকটি দল সরোয়ারের সঙ্গে মিলিত হয়ে হানাদারদের দোসর রাজাকার কমান্ডার আবদুল আলীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। তাদের কাছে ভাগীরথী যুদ্ধে অংশ নেয়ার আগ্রহ দেখান। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি হানদার ও তাদের দোসরদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের সামনে গিয়ে ভিক্ষুকের বেশ ধরেন। তাকে দেখে পাকিস্তানি সুবেদার সেলিম ভাগীরথীকে প্রস্তাব দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে গোপনে তথ্য দেয়ার। ভাগীরথী তার প্রস্তাবে সম্মত হন। তবে সেসব কেবল তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যই।
ওদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে ২৯ আগস্ট বাগমারায় হানাদারদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ভাগীরথীর তথ্যানুযায়ী তারা সেখানে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয়। ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর আবারও ভাগীরথীর দেয়া তথ্যে বাগমারা পোরগোলাসহ আশপাশের গ্রামে যায় তারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে হানাদাররা বুঝতে পারে তারা পাতানো ফাঁদে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। ফেরার পথে প্রতিশোধ হিসেবে নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
ক্যাম্পে ফিরে ক্যাম্প প্রধান ক্যাপ্টেন এজাজকে সব জানানো হলে এজাজ নিশ্চিত হয় ভাগীরথী প্রকৃতপক্ষে তাদের চর নয়, সে মুক্তিযোদ্ধাদের চর। ভাগীরথীকে হত্যা করার নির্দেশ দেন এজাজ।
১৩ সেপ্টেম্বর ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে এসে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর গতিবিধি ও তাদের খোঁজখবর নিতে থাকেন। তার শহরে ঢোকার খবর পৌঁছে যায় ক্যাম্পে। তাকে ধরে ফেলে রাজাকাররা। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাপ্টেন এজাজের সামনে। সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয়া হয় সবার সামনে ভাগীরথীকে হত্যা করার। এর পরই দুই সিপাহি রশি দিয়ে ভাগীরথীর দুই হাত বেঁধে তাকে মাটিতে ফেলে দেন এবং রশির অপর প্রান্ত মোটরসাইকেলের সঙ্গে বেঁধে দেন। সুবেদার সেলিম মোটর সাইকেল চালিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে ভাগীরথীকে টেনে তার রক্তে রঞ্জিত করে শহরের পিচঢালা পথ। এক সময় ভাগীরথী প্রাণহীন হয়ে পড়লে তার নিথর দেহটি নিক্ষেপ করা হয় বলেশ্বর নদে।
পিরোজপুরের সাংবাদিক খালিদ আবু বলেন, আমি স্বচক্ষে পোস্ট অফিস রোড থেকে ভাগীরথীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি। দেখেছি ভাগীরথীর রক্তাক্ত সাদা শাড়ি আর রাস্তায় রক্তের ছোপ।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার বর্তমানে পিরোজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান সরদার বলেন, ভাগিরথীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। তাকে যেভাবে শহরের রাস্তায় টেনেহেঁচড়ে হত্যা করা হয়েছে তা একমাত্র পশুদের পক্ষেই সম্ভব। পাকিস্তানি নরপশুরা তাই করেছে।
সাগর তীরের জেলা পিরোজপুরের খরস্রোতা বলেশ্বরের উত্তাল ঢেউ আর তীব্র স্রোতে ভাগীরথীর নিষ্প্রাণ দেহটি ভেসে যায় সাগরে। দুটি অবুঝ শিশু সন্তান আর আত্মীয়-স্বজনরা শেষবারের মতো দেখতেও পায়নি তাদের প্রিয়জন ওই বীর নারীটির মুখ।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক