ঢাকা ৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:০৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০২২
বরিশাল, নবকন্ঠ ডেস্ক :: রাজাপুর উপজেলার কৈবর্তখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩১ নম্বর ঘরটি মজিবর রহমানের নামে বরাদ্ধ। তিনি থাকে রাজাপুর সদরের বলাইবাড়ি এলাকার নিজ বাড়িতে। আশ্রয়নের ঘরটি দেখাশুনার জন্য থাকেন তার চাচাতো ভাইয়ের পরিবার। ২ কন্যা সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছেন মো. ইসমাইল। ইসমাইলের পৈত্রিক বাড়ি উপজেলার আঙ্গারিয়া হলেও সেখানে তার কোন জমি না থাকায় দীর্ঘ বছর ধরে চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন।
ইসমাইল-ফাতেমা দম্পতির ৪ কন্যা সন্তান থাকলেও তাদের কোন পুত্র সন্তান নেই। চট্টগ্রামে থাকাকালীন বড় দু’কন্যাকে পাত্রস্থ করেন পটুয়াখালী ও বরগুনাতে। মজিবর ঘর বরাদ্দ পাবার পরে তার ঘরে থাকতে আমাদের চট্টগ্রাম থেকে আনে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে আমরা এ ঘরে বসবাস শুরু করি। এমন কথাই জানান ফাতেমা বেগম।
৯০নম্বর ঘরটি বরাদ্ধ হয় পিয়ারা বেগমের নামে। উপজেলা প্রশাসন থেকে ঘরটি বুঝে নেয়ার পরে হাবিব নামের একজনকে দেখাশুনার জন্য সপরিবারে থাকতে দেন তিনি।
হাবিব একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তারও নিজস্ব কোন সম্পত্তি নেই। কিশোরী কন্যাসহ ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করতো হাবিব। ওই ঘরের সামনেই এখনও হাবিবের নাম ও মোবাইল নম্বর লেখা রয়েছে।
মেয়ে বিবাহ উপযোগী হওয়ায় ভালো পাত্রের কাছে বিবাহ দিতে ওই ঘরটি ছেড়ে উপজেলার নারিকেল বাড়িয়া গ্রামের শ্বশুরালয়ে বসবাস করছেন। এরপর ফারুক নামে এক ভাঙারী ব্যবসায়ীকে থাকতে দেন পিয়ারা বেগম।
রিক্সা চুরির অভিযোগে গত শনিবার (১২ নভেম্বর) ফারুকও ওই ঘরটি ছেড়ে চলে যান। এখন ওই ঘরটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ৮৫ নম্বর ঘরটি কার নামে বরাদ্দ তা জানেন না প্রতিবেশীরাও। তারা ঘরটি দেখিয়ে বলেন, আমরা কয়েকটি পরিবার এখানে বসবাস করছি।
ওই ঘরটি বরাদ্দের পরে এখন পর্যন্ত কাউকে আসতে দেখিনি। কার নামে বরাদ্দ তাও জানি না। সবসময় তালা দেয়াই থাকে। রাজাপুর সদর ইউনিয়নের আনসার কমান্ডার আ. শুক্কুরের নামে ২১নম্বর ঘরটি বরাদ্দ রয়েছে। তার ছেলে মেহেদী মাঝে মধ্যে ওখানে রাত যাপন করেন।
নিয়মিত কেউ থাকেন না ওই ঘরেতে। আরেক আনসার সদস্য মোজাম্মেল ও তার স্ত্রীর নামে ১৫০ ও ৩৭১ নম্বর ঘরটি বরাদ্দ রয়েছে। তারা দুজনে দুটি ঘরে থাকছেন। মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য জানাগেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মুজিববর্ষ উপলক্ষে জেলায় ২১৯টি আশ্রয়ণের ঘর রয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৮৮টি, নলছিটি উপজেলায় ১১০টি এবং রাজাপুর উপজেলায় ২১টি ঘর রয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার তথ্যানুযায়ী মুজিববর্ষে গৃহহীন উপকারভোগী ১হাজার ৪শ ৮২জন।
প্রথম পর্যায়ের ৪৭৪টি ঘরের সদর উপজেলায় ৫১টি, নলছিটি উপজেলায় ৪০টি, রাজাপুর উপজেলায় ৩শ ৩৩টি এবং কাঠালিয়া উপজেলায় ৫০টি। দ্বিতীয় পর্যায়ের ৪শ ৭২টি ঘরের সদর উপজেলায় ১২টি, নলছিটি উপজেলায় ৯৫টি, রাজাপুর উপজেলায় ৩৭টি এবং কাঠালিয়া উপজেলায় ৩শ ২৮টি।
তৃতীয় পর্যায়ের ৬শ ৮০টি ঘরের সদর উপজেলায় ১শ৩৮টি, নলছিটি উপজেলায় ৩শ ২টি, রাজাপুর উপজেলায় ১শ ৪১টি এবং কাঠালিয়া উপজেলায় ৯০টি। চতুর্থ পর্যায়ে নতুন ২শ ১৬টি ঘরের বরাদ্দ এসেছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১শ ১৮টি, নলছিটি উপজেলায় ৪৮টি, রাজাপুর উপজেলায় ৫০টি বরাদ্দ রয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত বরাদ্দ অনুযায়ী নির্মিত ঘর সুবিধাভোগী গৃহহীনদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের বরাদ্দ প্রাপ্ত ঘরের নির্মাণকাজ প্রায় ৯০ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে বরাদ্দ প্রাপ্ত ঘরের নির্মাণ কাজ শিঘ্রই শুরু করা হবে। জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। রাজাপুর উপজেলার কৈবর্তখালী আশ্রয়ণের ৩১নম্বর ঘরের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম জানান, আমার স্বামী ছোট থাকতেই তার বাবা স্বাধীনের সময় মারা যান।
ছোট সন্তান নিয়ে শ্বাশুরী উপজেলার তুলাতলা এলাকার ওই ঘরেই থাকতেন। পরবর্তিতে দুস্কৃতিকারীরা ঘরে আগুন দিয়ে আমার শ্বাশুরীকে নামিয়ে দিয়ে বসতভিটা দখল করে নেয়। বিভিন্ন বাড়িতে থাকতে থাকতে বছরখানেক পরে শ্বাশুরী মারা গেলে স্বামী ইসমাইল এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে খেয়ে না খেয়ে বড় হতে শুরু করে। এরপরে সে চট্টগ্রাম চলে যায়। সেখানে আমাদের বিবাহ হয়। আমরা দুজনেই উপার্জন করতে থাকি। ইতিমধ্যে আমাদের চারটি কন্যা সন্তান হয়।
উপার্জনে যা জমিয়েছিলাম তা বড় দুইমেয়ে বিয়ে দিতেই শেষ হয়ে গেছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে তখন ভাসুর মজিবর আমাদের এখানে থাকার জন্য চট্টগ্রাম থেকে আসতে বলে। গতবছরের ৫ডিসেম্বর আমরা এখানে বসবাস শুরু করি।
কয়েকমাস পরে ভাসুর মজিবর এসে আমাদের ঘর খালি করার জন্য বললে আমরা উপায়হীন এবং ঋণগ্রস্ত বলে এখানেই আছি। আমরাও ঘরের জন্য আবেদন করেছি, ঘর পেলেই ছেড়ে সেখানে যাবো। ৮৬ নং ঘরের বাসিন্দা আক্কেল আলী জানান, আবাসনে বসবাস করলে তাদের সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। ঘরে কোন বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারে না। তাই পিয়ারা বেগমের ৯০ নম্বর ঘরে হাবিব থাকলেও মেয়ের বিয়ে দিতে এখান ছেড়ে চলে যায়।
পরে বারেক নামের একজন ভাঙারী ব্যবসায়ী থাকলেও তিনি রিক্সা চুরির দায়ে কয়েকদিন আগে চলে গেছে। ৮৫নম্বর ঘরে কেউ থাকে না।কার নামে বরাদ্দ তাও জানি না। আমরা একবছরের বেশি সময় ধরে এখানে থাকছি কিন্তু ওই ঘরের কাউকে এখন পর্যন্ত দেখছি না।
রাজাপুর উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির আ. রহিম জানান, “ওই ঘর গুলোতে আমরা খোঁজ নিবো। প্রকৃত বরাদ্দপ্রাপ্তরা যদি না থাকে তা দেখে পরে ব্যবস্থা নিবো।” কিন্তু ওইসব ঘরের বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন।
রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান খান ভিডিও বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের কাছেও কিছু অভিযোগ আছে। আমরা মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে পরিদর্শনে যাই। কিন্তু ৩১, ৮৫ ও ৯০ নম্বর ঘরের তথ্যের সাথে আমাদের তথ্য মিলছে না। যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আলম ভিডিও বক্তব্য দিতে রাজি না হয়ে জানান, যাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়, তারা যদি ওই ঘরে না থাকেন তাহলে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে অন্য অসহায়দের নাম অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ দেয়া হবে।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক