দিন যত যাচ্ছে তত খাদের মধ্যে পতিত হচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। পুঁজি হারিয়ে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা এখন দিশেহারা। বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। পতনের এ ধারা কোথায় গিয়ে থামবে, তারও কোনো দিশা নেই। ফলে দিন যত যাচ্ছে শেয়ারবাজারে আস্থার সংকট তত প্রকট হচ্ছে। বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের হাহাকার।
গত কয়েক কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় বুধবার (২৮ মে) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। ভালো, মন্দ সব খাতের প্রতিষ্ঠানের ঢালাও দরপতনের কারণে মূল্যসূচকেরও বড় পতন হয়েছে। একই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।
এর মাধ্যমে চলতি সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। অব্যাহত দরপতনের মধ্যে পড়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে। অন্যভাবে বলা যায়, করোনা মহামারির আমলে ফিরে গেছে দেশের শেয়ারবাজার।
২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনা মহামারি শুরু হলে এতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। করোনার প্রভাবে জনজীবনের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন শুরু হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে, টানা ৬৬ দিন শেয়ারবাজার বন্ধ রাখার ঘটনা ঘটে।
করোনাকালীন দেশের শেয়ারবাজারে যেমন ভয়াবহ দরপতন দেখা গিয়েছিল, এখন আবার সে ধরনেরই দরপতন চলছে। অব্যাহত পতনের মধ্যে পড়ে বুধবার লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৬২ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৬১৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের ১০ আগস্টের পর সূচকটি এখন সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে।
শেয়ারবাজারের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিনিয়োগকারী মিজানুর রহমান বলেন, করোনো মহামারির সময়ের চেয়েও এখন বাজারের অবস্থা খারাপ। প্রতিদিন আশায় থাকি, বাজার ভালো হবে। কিন্তু সকালে একটু ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও পরে পতন শুরু হয়। অব্যাহত পতনের কারণে সিংহভাগ বিনিয়োগকারী ৬০-৭০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন। বাজারের যে অবস্থা বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায় নেই। বাজারে এখন সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা।
বিনিয়োগকারী মো. সোহাগ বলেন, শেয়ারবাজারের দিকে থাকলেই এখন কষ্ট লাগে। সবার চোখের সামনে পুঁজিবাজার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হচ্ছেন। শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় কারও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তো ধীরে ধীরে উন্নতি করছে, তাহলে শেয়ারবাজার কেন এমনভাবে ধুঁকছে। আল্লাহ্ ছাড়া আমাদের এখন রক্ষা করার কেউ নেই।
এদিকে, চতুর্থ কার্যদিবসে প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি কমেছে অন্য দুই সূচক। বাছাই করা ভালো ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৭০৮ পয়েন্টে নেমেছে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
দিনের লেনদেন শেষে সব খাত মিলে ডিএসইতে ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৯৫টির। আর ৪০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ভালো কোম্পানি বা ১০ শতাংশ অথবা তার বেশি লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৯টির শেয়ার দাম বেড়েছে। বিপরীতে ১৬৮টির দাম কমেছে এবং ২২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
মাঝারি মানের বা ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া ১০টি কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার বিপরীতে ৬৯টির দাম কমেছে এবং ৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়ার কারণে পঁচা ‘জেড’ গ্রুপে স্থান হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৪টির শেয়ার দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৫৮টির এবং ১৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে ২০টির দাম কমেছে এবং ১৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দাম কমার পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৬৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ২৭২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন কমেছে ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে টানা ১৩ কার্যদিবস ডিএসইতে তিনশো কোটি টাকার কম লেনদেন হলো।
এদিন ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেনে হয়েছে বিচ হ্যাচারির শেয়ার। কোম্পানিটির ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফু-ওয়াং ফুডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকার। ৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ওরিয়ন ইনফিউশন।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ব্র্যাক ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, শাইনপুকুর সিরামিকস, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ এবং সোনারগাঁও টেক্সটাইল।
অন্য শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৩৮ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ১৯৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৪২টির এবং ১৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ১০ কোটি ১১ লাখ টাকা।