ঢাকা ১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৫৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২৫
সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক এবং বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে মহাসড়ক এবং ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এই চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে হামলা, মামলা, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনও করছে।
ভুক্তভোগী পথচারীরা জানায়, জনগণের চলাচলের জন্য ওভারব্রিজ তৈরি করা হলেও তা অবৈধ দখলে। বৃষ্টি বা রোদের সময় একটু আশ্রয় নেওয়ার জায়গাটুকুও মেলে না।
বিশেষ করে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই পরিস্থিতি বেশি কষ্টদায়ক।
গত কয়েক দিন সাভারের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর, উলাইল, গেণ্ডা, সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর, বাইপাইল, বলিভদ্র, শ্রীপুর, নয়ারহাট, জামগড়া, নরসিংহপুর, জিরাবো ও আশুলিয়া এলাকা ঘুরে চাঁদাবাজির একই চিত্র লক্ষ করা গেছে।
গাবতলী সেতু পার হলেই আমিনবাজার বাসস্ট্যান্ড। এখানে মহাসড়কে আট লেন করা হলেও দুই পাশের লোকাল লেনগুলোতে যানবাহন এবং মানুষের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ড্রেনের ওপর দিয়ে মানুষের চলাচলের রাস্তা নির্ধারণ করা হলেও সেখানে দোকান বসিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। মহাসড়কের অর্ধেকের বেশি জায়গাজুড়ে দোকানপাট বসিয়ে এবং গাড়ি পার্কিং করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বলিভদ্র এলাকায় ফুটপাত দখল করে তৈরি করা হয়েছে আট শতাধিক অস্থায়ী দোকান। নবীনগর স্মৃতিসৌধ এলাকায়ও শতাধিক দোকান বসেছে।
সম্প্রতি নবীনগর-চন্দ্রা হাইওয়ে সড়কের পাশে ফুটপাতে চাঁদা তোলার সময় স্থানীয় হকার ও এলাকাবাসী জাকির হোসেন নামের একজনকে গণপিটুনি দিয়েছে।
হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সঙ্গে মানিকগঞ্জ-সিংগাইর সড়কের সংযোগ। এখানে বিশাল জায়গাজুড়ে বাসস্ট্যান্ড এবং ফুটপাত রাখা হলেও পথচারীরা নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারছে না। সড়ক ও জনপথের জমিসহ মহাসড়কের ওপর দোকানপাট এবং গাড়ি পার্কিং করিয়ে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে মোশারফ বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিটি দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি ময়লা পরিষ্কার, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন নামে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেমায়েতপুর হাজি আশরাফ শপিং কমপ্লেক্সের সামনে থেকে প্রতিদিন যাদুরচরের ফারুক, শাহ আলম, দেলোয়ার, শাহিন, সিয়াম ও ভাগ্নে সানির নেতৃত্বে দোকানপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। পাশেই মক্কা টাওয়ারের সামনে থেকে দোকানপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায়ে নেতৃত্ব দেন যাদুরচরের ময়লা জুয়েল, তাঁর ছোট ভাই রতন শেখ এবং জুয়েলের ছেলে রাসেল। এভাবেই হেমায়েতপুর বাজার এবং মোল্লা মার্কেটের সামনের প্রতিটি দোকান থেকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দোকানপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
হেমায়েতপুর-সিংগাইর সড়কের অর্ধেকের বেশি জায়গায় দোকান এবং গাড়ি পার্কিং করে প্রত্যেক দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয় ৫০০ টাকা। হেমায়েতপুর ওভারব্রিজের দুই পাশের সিঁড়ি দখল করে বানানো দোকান থেকে ২০০ টাকা করে এবং প্রাইম ব্যাংক মাদু হাজির বাড়ির সামনে প্রত্যেক দোকান থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন জনৈক নজরুল।
সম্প্রতি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির টাকা ভাগ-বাটোয়ারা এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আশরাফুল ইসলাম আরিফকে হাতুড়িপেটা করে দুই পা ও বাঁ হাতের হাড় কয়েক টুকরা করেছে অন্য গ্রুপের হকাররা। বর্তমানে পৌরসভার সামনেই গেণ্ডা কাঁচাবাজারে সড়ক ও জনপথের জমিতে ভিটি বানিয়ে শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ৭০ হাজার টাকা অগ্রিম জামানত নিয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা চাঁদা তুলছেন সেই আশরাফুল। এখানে এককালীন তোলা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা এবং মাসিক ভাড়া আদায় করা হচ্ছে অন্তত ১৮ লাখ টাকা।
পুলিশ ও হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু সাভার বাসস্ট্যান্ডের উভয় পাশের ফুটপাত ও সওজের জমিসহ মহাসড়কের ওপর তিন হাজারেরও বেশি ভাসমান দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন তিন লাখ টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করা হয়। সাভার অন্ধ মার্কেটের সামনে সাভার-বিরুলিয়া সড়ক দখল করে চৌকি বসিয়ে শতাধিক দোকান থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে মার্কেটটির ইনচার্জ আব্দুর রহিম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনা আড়াল করতে দৃষ্টিহীনদের কাজে লাগিয়ে মার্কেট ইনচার্জ রহিম উল্টো মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমাদের মার্কেটের সামনে আমরা দোকান না বসালে অন্যরা দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি করে। তাই জনগণের চলাচলের কথা না ভেবে আমরাই দোকান বসিয়েছি।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাঝেমধ্যে প্রশাসন থেকে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করা হলেও কয়েক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি আবার আগের মতোই হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের অসহযোগিতা এবং চাঁদার টাকার ভাগ পাওয়ায় এই অবৈধ দখলদারি একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুর এলাকাটি শিল্প অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে চাঁদাবাজির মাত্রাটা বেশি। এসবের নেতৃত্বে রয়েছেন মোশারফ হোসেন। হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে জয়নাবাড়ি সড়কে ও হেমায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে নির্মিত মার্কেটে শতাধিক দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। স্কুলের নাম করে তোলা এসব চাঁদা এত দিন আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে গেলেও এখন যাচ্ছে ভিন্ন ব্যক্তির পকেটে।
চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে আন্ত জেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনের মুঠোফোনে কল করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সাভার নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন খান নঈম বলেন, অবৈধ ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে জোর দাবি জানিয়েছি। জেলা প্রশাসক আশ্বাস দিয়েছেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুবকর সরকার বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ট, হেমায়েতপুর, আশুলিয়ার জামগড়ায় অবৈধ ফুটপাত দখল উচ্ছেদ করেছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। দ্রুত সাভার ও আশুলিয়ার ফুটপাতগুলো সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক