ভোলায় কৃষকের স্বপ্ন পুড়ছে নোনা পানি

প্রকাশিত: ৭:৩৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০২২

নিউজটি শেয়ার করুন

 

পশ্চিমের তেঁতুলিয়া আর পুবে মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত ভোলা। এখানকার কৃষকরা তেঁতুলিয়া নদীর মিষ্টি পানির ওপরই বেশি নির্ভর করে ফসল ফলান। তবে দুর্বল স্লুইসগেট দিয়ে মেঘনার লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে খেতের বোরো ফসলের চারা ধান জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ফলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

 

অন্যদিকে পানি চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া খালে বাঁধ দিয়ে সড়ক উন্নয়নের কাজ করায় তীব্র পানি-সংকটে পড়েছেন জেলার পূর্বাঞ্চলের বোরো চাষিরা। মিষ্টি পানির অভাবে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান খরায় আক্রান্ত। ফেটে চৌচির ধানখেতগুলো। মাঝপথে ফসলের এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা কৃষকরা প্রায় দেড় শ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অপরিকল্পিত সড়কের উন্নয়নকাজের কারণে পুঁজি হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন কয়েক শ কৃষক।

 

সরেজমিনে জানা যায়, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের মাঝিরহাটের পাশ দিয়ে তেঁতুলিয়া নদী থেকে উঠে আসা মুখরবান্দা খালটি আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, জিন্নাগড়, ওসমানগঞ্জ, আসলামপুর ইউনিয়ন হয়ে মেঘনা নদী থেকে উঠে আসা বেতুয়া খালের সঙ্গে মিশেছে। চরফ্যাশন উপজেলা সদরের প্রবেশমুখ মুখরবান্দা খালে বাঁধ দিয়ে সেতু নির্মাণের কাজ করছে সড়ক বিভাগ। বাঁধের ওপর দিয়ে যান চলাচলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করলেও পানি যাওয়া-আসার সুযোগ রাখা হয়নি। এতে বাঁধের পূর্বদিকের অংশের খালটি শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।

 

ফলে খালের দুই পাড়ের আলীগাঁও ও খোদেজাবাগ গ্রামের প্রায় ৪০০ একর বোরো খেত খরায় আক্রান্ত হয়েছে। এসব বাঁধের কারণে পানির অভাবে খাল শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। চোখের সামনেই মাঠজোড়া সবুজ ধানগাছগুলো ধীরে ধীরে লাল হয়ে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় অনেক চাষি বাড়ির পুকুর আর ডোবা-নালা থেকে বিকল্প উপায়ে সেচ দেওয়ার চেষ্টা করেও ধানগাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

 

এই দুই গ্রামের মতো একই অবস্থা চরফ্যাশন, লালমোহন ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার ১২ হাজার হেক্টর বোরো খেতের।

 

পাশাপাশি চরফ্যাশনের বেতুয়ায় মেঘনা পারে ২০০৫ সালে নির্মিত স্লুইসগেট কোনো কাজে আসে না এখানকার কৃষকসহ সাধারণ মানুষের। এটি দিয়ে সাগরের লোনা পানি ঢুকে মেঘনা নদী-সংলগ্ন শত শত একর জমির ফসল লোনা পানিতে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে পানির অভাব, অন্যদিকে লোনা পানির চাপে কৃষকরা দিশেহারা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষ।

 

ক্ষতির মুখে পড়া এসব কৃষক জানিয়েছেন, এ বছর বোরো চাষে একরপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। যেভাবে ধানের চারাগুলো পুড়ে যাচ্ছে, তাতে পুঁজি ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা না দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

 

চরফ্যাশন উপজেলা আসলামপুর ইউনিয়নের কৃষক মো. শাজাহান বলেন, চারদিকে পানি আর অতি লাভের আশায় ফসল করেছেন এ বছর। আশানুরূপ সব ফসল ভালো হলেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বোরোর আবাদ করে। আগ থেকে কৃষকদের পানি বন্ধের কোনো খবর না জানিয়ে সব খাল বন্ধ করে কালভার্ট নির্মাণ করায় বিপাকে পড়েছেন তারা। একদিকে সাগরের লোনা পানি, অন্যদিকে মিষ্টি পানি না থাকায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

 

কৃষক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, অনেক আশায় বোরো ধানের চাষ শুরু করেছি। তবে এ বছর এমন বিপদ হবে তা বুঝতে পারিনি। সড়ক ও জনপথের প্রধান সড়কের কালভার্ট নির্মাণ করতে গিয়ে সব খালে বাঁধ দিয়েছে। ফলে পানি আসতে না পারায় বিপদে আছি আমরা।

 

কৃষক মো. ইয়াকুব আলী বলেন, এনজিওতে কিস্তিতে টাকা লইয়া চাষাবাদ শুরু করছি। এহন পশ্চিমের পানি না থাকায় পথে বইয়া গেছি। বহু বছর আগে মেঘনার পারে একটা স্লুইসগেট দিছে, যা নষ্ট থাকায় লোনা পানি ঢুকে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আমাগো ভবিষ্যতের জন্য একটা গভীর নলকূপ দিলে আমাগো কিছুটা রক্ষা হইত।

 

উপজেলা আসলামপুর ইউনিয়ন দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন সরেজমিন পরিদর্শন করে জানান, এখানে গভীর নলকূপ ও ক্ষতিগ্রস্ত স্লুইসগেট নির্মাণ করা হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন। এটা আমাদের কাজ নয়, বিআরটিসির কাজ। তারা আমাদের কাছ থেকে চাহিদা নিয়েছে। তবে কাজ শুরু করেনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকেও অবহিত করেছি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

 

চরফ্যাশন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান, তারা স্লুইসগেট নির্মাণ ও খাল খননের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। একনেকে পাস হলেই ক্ষতিগ্রস্ত স্লুইসগেট পুনর্নির্মাণ এবং ১০ বেন্টের আরেকটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হবে। যাতে সেখান দিয়ে ট্রলার ও নৌকা চলাচল করতে পারে। একই সঙ্গে ১৯ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে। এসব করা সম্ভব হলেই কৃষকদের আর সমস্যা থাকবে না। তারা সহজেই মিষ্টি পানি পাবেন এবং লোনা পানির প্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হবে।

 

ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাসান ওয়ারিসুল কবীর জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্মাণাধীন সড়কে কালভার্ট পুনর্নির্মাণের জন্য যে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, সেই বাইপাস সড়কে তলদেশ দিয়ে কোনো পানি চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় ভোলা-চরফ্যাশনে এ বছর তেঁতুলিয়া নদীর মিষ্টি পানি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এখানকার কৃষকরা। আমরা কৃষি বিভাগ সংসৃষ্ট দফতরের সাথে যোগাযোগ করেছি তারা অচিরেই সমাধান করবে বলে আশাবাদী।

 

তিনি আরও জানান, বোরো খেতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা কৃষি বিভাগের। এ মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে তারা। এদিকে টেকসই স্লুইজগেট নির্মান ও খাল খননের মাধ্যমে ভোলার কৃষকদের ফসলের পানি সরবরাহ স্বাভাবিক করা এবং সরকার যেন ক্ষতিগ্রস্থ্য কৃষকদের পাশে থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পাড়ে তার ব্যবস্থা করবেন, এমনটাই দাবী ভোলার সচেতন মহল ও কৃষকদের।

 

উল্লেখ্য, জেলা সদর থেকে চরফ্যাসনের বাবুরহাট পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তমহাসড়কের বর্তমান প্রস্থ ১৮ ফুট। এটি ৩০ ফুটে উন্নীত করা হচ্ছে। সড়ক উন্নয়নের সাথে খালে বাঁধদিয়ে ৪টি সেতু ও ৪৩টি কালভার্ট ভেঙে নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে। এ বাঁধের কারণে ৩ উপজেলায় ৫টি খালে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে।


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ