ঢাকা ১০ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:২২ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২৩
নবকন্ঠ ডেস্ক, বরিশাল:: বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের চর লড়াইপুরের বাসিন্দা মিলন মাঝি। বছরের অন্য সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও মৌসুমে তরমুজ চাষ করেন। বিগত বছর ভালো দাম পেলেও এ বছর তিনি খরচ তুলতে পারছেন না। বিক্রির জন্য ট্রলারভর্তি তরমুজের চালান নিয়ে এসে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ তিনি। মিলন মাঝি বলেন, ‘দাদনের টাহা উঠবে না ভাই। দোষ দিমু আর কারে? পানির দামে তরমুজ দিয়াও খরচার টাহা উঠবে না এবার।’
আরেক চাষি মাসুদ মিয়া ট্রলার থেকে কীর্তনখোলার শাখা খালে ছুড়ে ফেলছিলেন পচে যাওয়া তরমুজ। তিনি বলেন, তরমুজ বিক্রি করে আগামী বছর ভালোভাবে সংসার চালানোর ইচ্ছা ছিল। তা আর হলো না। আসতে আসতেই ট্রলারে পচে গেছে অনেক তরমুজ। এখন ট্রলার ভাড়া আর শ্রমিক খরচ দিয়ে আড়তদারের দাদনের টাকা শোধ করার উপায় নেই। সংসার চালানোর কথাতো আসবে পরে।
শুধু মিলন মাঝি বা মাসুদ মিয়া নন এমন হাজারো চাষির স্বপ্ন কীর্তনখোলা নদীতে ভাসিয়ে দিতে দেখা গেছে রোববার (২ এপ্রিল)। ফলন ভালো হলেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের চাষীরা। মুনাফা তুলতে ‘পানির দামে’ পাইকারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ক্ষেতভর্তি তরমুজ। আবার অনেকেই নদীতে ফেলে দিচ্ছেন। পাশাপাশি পরিবহনের অসুবিধার জন্য ট্রলারেই পচে যাচ্ছে মৌসুমের চাহিদা সম্পন্ন লাল সবুজের সোনালী শস্য। কৃষকরা বলছেন, তিন ধরণের ক্ষতির মুখে দাদনের টাকা পরিশোধ দায় হয়ে যাবে এবার।
বরিশালের সবচেয়ে বড় পাইকারী ফলের আড়ত পোর্ট রোড ঘুরে দেখা গেছে, তরমুজবোঝাই শত শত ট্রলার আড়তের খালে নোঙর করে আছে। কোনোটির পণ্য নামানো হচ্ছে। কোনোটিতে চাষি আর আড়তদারের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। শ্রমিকরা ব্যস্ত ট্রলারের পর ট্রলার তরমুজ খালি করতে। ছিন্নমূল আর নিম্ন আয়ের মানুষ ফেলে দেওয়া তরমুজ সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। গরুকেও ফেলে দেওয়া তরমুজ খেতে দেখা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ি বরিশাল থেকে জানানো হয়েছে, বরিশাল জেলায় তরমুজ চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০০ হেক্টর জমিতে, আবাদ হয়েছে ১০৪৬ হেক্টর জমিতে। পিরোজপুরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৬ হেক্টর জমিতে, ১১৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। ঝালকাঠিতে লক্ষ্যমাত্রা না থাকলেও ৫৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। পটুয়াখালীতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না হলেও আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে। বরগুনায় ১১ হাজার ৫১২ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৮৩৮ হেক্টর জমিতে। ভোলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমিতে, ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
ভোলা থেকে আসা তরমুজ চাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় পুরো ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। আগে ক্ষেতে যেত পাইকার। এ বছর বৃষ্টি হওয়ার পরে পাইকারও পাচ্ছি না। এজন্য ট্রলারে করে নিয়ে এসেছি। এখানে তরমুজ পানির দামে দিয়েও কেউ কিনতে চাইছে না। খুচরা বাজারে যে তরমুজটি বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুইশ টাকায়, আমরা সেটির দাম ৫০-৬০ টাকাও পাচ্ছি না।
আরেক চাষি ইকবাল হোসেন বলেন, সপ্তাহখানেক সময় পেলে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করতাম। আগে বৃষ্টি হওয়ায় তরমুজের গায়ে দাগ লেগে গেছে। এই মৌসুমে ছয় লাখ টাকা খাটিয়েছিলাম। সেই টাকা উত্তোলন করা মুশকিল মনে হচ্ছে।
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ইকরী গ্রামের তরমুজ চাষি আব্দুল লতিফ বলেন, বরিশাল পোর্ট রোডে গরু তরমুজ খাচ্ছে দেখছি। উপায় নেই, মানুষের খাদ্যের দাম চাষি না পেলে গরুতে খাওয়াই ভালো। ভালো দামের আশায় বরিশালে নিয়ে আসতে আসতে অনেক তরমুজ ট্রলারে পচে গেছে।
রসুলপুরের বাসিন্দা সবুজ বলেন, তরমুজগুলো নদীতে ফেলে দেওয়ায় পুরো এলাকায় পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের টেকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার তরমুজ চাষি আলমগীর হোসেন বলেন, তরমুজ নালা পদ্ধতিতে চাষ করে থাকি আমরা। ওই নালায় কীটনাশক ও সার দিয়ে রাখা হয়। নালায় পানি দিলে তোষণ করে সেই কীটনাশক ও সার শুষে নেয় তরমুজ গাছ। কিন্তু বৃষ্টিতে ক্ষেত ডুবে যাওয়ায় কীটনাশক ও সার ছড়িয়ে পড়ে গাছ মরে যাচ্ছে। পচে যাচ্ছে তরমুজ।
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়েদুল আলম বলেন, তরমুজ উত্তোলনের ভরা মৌসুমে বৃষ্টিতে এবার কৃষক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গত বছর এই বৃষ্টি হয়েছিল উত্তোলন সময়ের পরে। যে কারণে ওই বছর ভালো দাম পেয়েছিলেন কৃষকরা। কিন্তু এবার মাঠেই প্রায় ২৪ হেক্টর জমির তরমুজ পচে গেছে। কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তাদের সহায়তার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বৃষ্টিতে ১২ শ হেক্টর জমির তরমুজ ক্ষতির মুখে রয়েছে। বৃষ্টি আরও কিছু দিন পরে হলে যে কোনো বছরের তুলনায় এবার লাভবান হতে পারতো চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্যান বিশেষজ্ঞ জিএমএম কবীর খান বলেন, এবার বরিশাল অঞ্চলে তরমুজের ভালো ফলন হয়েছে। সারাদেশে যেই পরিমাণ তরমুজ ফলন হয়েছে তার প্রায় ৭০ শতাংশই এই অঞ্চলের। ফলন ভালো হলেও বৃষ্টির কারণে চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তরমুজ ক্ষেতে পানি জমে গেছে। কোথাও কোথাও শিলা বৃষ্টি হয়েছে। আর শিলার আঘাতে তরমুজে পচন ধরে। আবার তরমুজ ৩-৪ দিন পানিতে ডুবে থাকলে ভেতরে পচন ধরতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে তরমুজে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। জমে থাকা ক্ষেতের পানি নিষ্কাশনে নালা কেটে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পরে ওইসব ক্ষেতে ওষুধ ছেটানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ভালো পরিচর্যা এবং রোদের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পচন রোধ হবে বলে তিনি জানান।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক