ঢাকা ৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:১৪ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৩
প্রসূতিদের চিকিৎসা করেন সাবেক মেডিকেল অফিসার জি.কে. চক্রবর্তী। রোগী দেখেন নগরের সদররোডের বেলভিউ হসপিটাল এন্ড মেডিকেল সার্ভিসেস (প্রাঃ) লিমিটেডে। তিনি একজন রোগীর কাছ থেকে ফি (ভিজিট) নেন এক হাজার ৮০০ টাকা। একই রোগী দ্বিতীয়বার দেখাতে গেলে দিতে হবে ১২০০ টাকা। কিন্তু রোগীর চিকিৎসার মেয়াদ তিন মাস পার হয়ে গেলে আবারও নতুন রোগীর মতো ১৮০০ টাকা গুণতে হবে।
ঐ হাসপাতালে গত শনিবার দুপুরে গৃহবধূ রেশমা বেগম খুঁজছিলেন গাইনি ডাক্তার। পরিচিত একজনের কাছ থেকে ডাক্তার জি.কে চক্রবর্তির নাম শুনে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ঐ হাসপাতালে আসেন। কিন্তু চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে সাইনবোর্ডে লাগোনো ভিজিট দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি।
এসময় প্রতিবেদকের সাথে দেখা হয় হলে তিনি বলেন, ‘এটা কী করে সম্ভব! ভিজিটই যদি ১৮০০ টাকা দিতে হয় তবে এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাব কিভাবে? বাংলাদেশে অন্য কোনো গাইনি ডাক্তারের এত টাকা ভিজিট আছে বলে শুনিনি। এই ডাক্তার কি শুধু বড়লোকদের চিকিৎসা করবেন? গরিব রোগীদের কি তাঁর সেবা পাওয়ার অধিকার নেই।’
ভিজিটের দিক থেকে দ্বিতীয় রয়েছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রণজিৎ খাঁ। বিবির পুকুর পাড় সংলগ্ন কনিকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী দেখেন তিনি। প্রথমবার রোগীর কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন এক হাজার ৩০০ টাকা।
সদর রোডের বেলভিউ মেডিকেল সার্ভিস ও বান্দ রোডের ইসলামীয়া হাসপাতালে রোগী দেখেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক ডা. অমিতাভ সরকার। তাঁর ভিজিটও এক হাজার টাকা।
ল্যাব এইডে রোগী দেখেন নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম আর তালুকদার মুজিব। প্রথমবার তিনি ভিজিট নেন এক হাজার টাকা। দ্বিতীয়বার গেলে নেন ৮০০ টাকা।
তাঁর কাছে চিকিৎসা নেওয়া আলমগীর হোসেন বলেন, ‘েদশের বাইরে অনেক জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু এখানকার মতো ভিজিট নিয়ে চিকিৎসকদের এমন বেপরোয়া বাণিজ্য পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। এখানকার ডাক্তাররা ইচ্ছামতো ভিজিট নির্ধারণ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে একই রোগের চিকিৎসার জন্য একেক ডাক্তার একেক রকম ভিজিট নেওয়ায় মানুষের হয়রানির সীমা থাকে না।’
শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কোথাও কোনো ডাক্তারের ভিজিটই এখন ১০০০ টাকার নিচে নেই। বরং ১০০০ থেকে শুরু করে যে যাঁর মতো ইচ্ছা বেশি ভিজিট নিচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাঁদের প্রশ্রয় দেয়।
জানা গেছে, এসকল চিকিৎসকরা প্রতিদিন রোগী দেখেন ৪০-৫০ জন করে। কেউ কেউ অবশ্য আরো বেশি রোগী দেখেন, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের চেম্বারের বাইরে সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকে রোগীরা। ফলে দিনে কেবল রোগীর ফি থেকেই তাঁদের আয় হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে ল্যাবরেটরি-প্যাথলজি-ওষুধ কোম্পানি ও হাসপাতালসহ নানা উৎস থেকে আসে আরো কয়েক হাজার টাকা। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় তাদের নীতি-নৈতিকতার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চিকিৎসকদের এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানবিকতা বলে কিছুই থাকবে না মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগীরা জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে আইন, নীতিমালা বা গাইডলাইনও নেই। একবার ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে আর তা এগোয়নি।
বরিশাল সচেতন নাগরিক (সনাক) জেলার সভাপতি গাজি জাহিদ হোসেন বলেন, সত্যিই যেন এখন বেশির ভাগ ডাক্তার একরকম টাকার মেশিন হয়ে উঠছেন। যা নীতিহীন ও অন্যায়। এতে রোগীরা কেবল হয়রানির শিকারই হচ্ছে না, চিকিৎসা করাতে এসে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারও দায় এড়াতে পারে না। কারণ নাগরিকসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ডাক্তারদের ভিজিট ও কমিশন নিয়ে যে প্রকাশ্য বাণিজ্য চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
ফি নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল ডাক্তার জি.কে চক্রবর্তি ও রনজিৎ, এম আর তালুকদার মুজিবের খাঁর সঙ্গে। মুঠোফোনে তাদের বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ফোন রিসিভ না করা এবং বন্ধ পাওয়ায় জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল সভাপতি ডা. মোহাম্মদ ইসতিয়াক হোসেন বলেন, সরকারী নিতি মালা না থাকার সুযোগে চিকিৎসকরা নিজেরাই ভিজিট বাড়িয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন সময় সভা সেমিনারে এ বিষয় বলা হয়। কিন্তু তাঁরা মানচ্ছে না।
তিনি বলেন, একজন চিকিৎসকের ভিজিট হওয়া উচিত ৫০০ টাকা। বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যর মূল্য বৃদ্ধিতে সব মানুষের মতো চিকিৎসকদের চরিত্র পাল্টে গেছে। তাই একজন চিকিৎসক তাদের দায়িত্ব বোধ হারিয়ে টাকার নেশায় মগ্ন হয়ে উঠেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা ডাক্তাররা যেহেতু অন্য যেকোনো পেশাজীবীদের চেয়ে আলাদা বা মানুষের জীবন-মরণের সেবামূলক ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছি, তাই এ ক্ষেত্রে নিজেদেরই আরো সচেতন ও নীতি-আদর্শ মেনে চলা উচিত।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক