সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপানো এবং বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করেছে। বিশেষ করে, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়।
এবারের ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপাতে এরকম অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ৩৬টি প্রেসের (মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান) বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। গত এপ্রিল মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠার পর সম্প্রতি শুরু করা এই অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে নানা তথ্য চেয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এই ৩৬টি প্রেস হল- অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস; আমিন আর্ট প্রেস; আনন্দ প্রিন্টার্স; অনন্যা, সরকার ও বলাকা প্রিন্টার্স; আনোয়ারা, কচুয়া প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স; অনুপম প্রিন্টার্স লি.; অটো ও মোল্লা প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স; বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং প্যাকেজিং; ভাই ভাই প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স; ব্রাইট, প্রোমা প্রিন্টিং প্রেস; বৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস; দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স; ফাহিম প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স; দোহার, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স; ফায়িজা প্রিন্টিং প্রেস; ফাথিন প্রিন্টিং; ফাইভ স্টার প্রিন্টিং; ফরাজী প্রেস পাবলিকেশন।
এ ছাড়াও আরও রয়েছে- হাওলাদার অফসেট প্রেস; কাশেম এন্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেস; দ্যা গুডলাক প্রিন্টার্স; আলিফ প্রিন্টিং প্রেস; মেরাজ প্রিন্টিং প্রেস; পানামা প্রিন্টার্স; মৌসুমী অফসেট; জনতা প্রেস; নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস; পাঞ্জেরী প্রিন্টার্স; খন্দকার এন্টারপ্রাইজ; প্রিয়ায়াংকা প্রিন্টিং; রেদওয়ানিয়া প্রেস; এস আর প্রিন্টিং; এস এস প্রিন্টার্স; শৈলী প্রিন্টার্স, টাঙ্গাইল অফসেট; সোমা প্রিন্টিং; ভয়েজার পাবলিকেশন্স; রূপালী প্রিন্টিং এবং ঢাকা প্রিন্টার্স।
চিঠিতে দুদক বলছে, এনসিটিবির অনুকূলে বিগত ১০ বছরে এনসিটিবি থেকে বই সরবরাহ সংক্রান্ত কয়টি কার্যাদেশ পেয়েছে, কার্যাদেশগুলোর বছরভিত্তিক মূল্য কত ছিল, কোন বছরে নিম্নমানের বই সরবরাহ করা হয়েছে কিনা বা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে অন্যকোনো অনিয়ম ছিল কিনা বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত পরিচালনা করা হয়েছিল কিনা, সে সংক্রান্ত তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর তানভীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব খাটিয়ে কয়েক মাস আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে বাণিজ্য করেছেন। কোটি কোটি টাকা নিয়ে ডিসি নিয়োগের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক বিতর্ক ওঠে। বাধ্য হয়ে সরকার ঘটনা তদন্তে তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে।
এরপর গত মার্চে এনসিটিবি ‘বাণিজ্যে’ নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি। অভিযোগ ছিল, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বই ছাপানোর কাগজ কিনলেই কেবল বই ছাপার ছাড়পত্র দেন তিনি। না কিনলে ছাড়পত্র মেলেনি। আর ওই কাগজ কিনতে টনপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে। এর বাইরেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২১ এপ্রিল গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে এনসিপি। এরপর গত ১৫ মে দুদক থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তানভীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। তখন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নামে বেনামে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে, গত ২৪ জুন এক চিঠিতে দুদকের পক্ষ থেকে নানা কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে এনসিটিবির কাছ থেকে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, গাজী সালাউদ্দীন তানভীর ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং এনসিটিবির টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নামে বে-নামে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। এই অভিযোগটি সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে নিম্নবর্ণিত রেকর্ডপত্র সংগ্রহপূর্বক পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন।
‘‘এ অবস্থায় যাচিত রেকর্ডপত্র/কাগজপত্রাদির মূল কপি সংরক্ষণপূর্বক সত্যায়িত ছায়ালিপি নিম্নস্বাক্ষরকারীর নিকট (দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, সেগুনবাগিচা, ঢাকা) ২৯ জুনের (আজকের) মধ্যে সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করা হলো।‘’
তবে এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দুদককে সরবরাহ করতে পারেনি এনসিটিবি। বিষয়টি নিশ্চিত করে আজ রবিবার এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছানোর কাজ করছি। এরপর দুদকে জমা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, দুদক থেকে একটি চিঠি পেয়েছি, প্রেসগুলোর ব্যাপারে যেসব তথ্য, কাগজ চেয়েছে তা দেওয়া হবে। দুদক তদন্ত করে অভিযোগ পেলে, এনসিটিবি ব্যবস্থা নেবে।