বরগুনা

আমতলীতে ইটভাটায় পুড়ছে শিশুর স্বপ্ন

By admin

February 12, 2022

 

তিন বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি তাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী।

 

আমতলী উপজেলার ইটভাটাগুলোতে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে শিশু শ্রমের মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞের আগুনে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ।দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ছে এসব শিশুর ভবিষ্যৎ। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা মায়ের আদরে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব শিশুরা। আমতলী উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কাজ করছে একদল শিশু। এদের সবারই বয়স ৭ থেকে ১৬ বছর। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ এসেছে তার মা-বাবার সঙ্গে, কেউ শ্রমিক সরদারের সঙ্গে।

 

এসব শিশুরা সাতক্ষীরর বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসেছে ছয় মাসের কাজের চুক্তিতে। চুক্তি ফুরালেই আবার ফিরবেন আপন ঘরে। তবে ততো দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে পুরোমাত্রায়। ইটভাটাতেই ভাটার বড় শ্রমিকদের পাশাপাশি কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত আছে এই শিশুরা। প্রত্যেক কাজই বড়দের মতো করে করতে হয় তাদের।

ছোট বেলা থেকেই ইটভাটায় কাজ করতে করতে যেমন শিক্ষা ও অধিকার থেকে ছিটকে পড়ছে এখানকার শিশুরা, ঠিক তেমনি কাজ করতে করতে মারাত্মক সব রোগের শিকার হতে হচ্ছে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা। শিশুকাল তাদের মনের পাশাপাশি শরীরেরও গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। কিন্তু ভাটার শিশুদের মন ও শরীর দুটো আক্রান্ত হয় রোগে-শোকে।

 

আমতলী উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালের প্রশাসক ডা: মোনায়েম সাদ বলেন, ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

 

আমতলী উপজেলা প্রশাসন ইটভাটা মালিক সূত্রে জানা যায, উপজেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ভাটার সংখ্যা ২২ টি ইটভাটা রয়েছে । প্রায় প্রতিটি ইটভাটাতেই শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। আমতলী উপজেলায় বৈধ-অবৈধ ২২টি ইটভাটায় প্রায় ২শতাধিক শিশু শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত আছে। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ধুলা-ময়লার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব কোমলমতি শিশু। পরিবারের অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণেই এ পরিস্থিতির শিকার বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

 

জেলার আমতলী উপজেলার খেকুয়ানী গ্রামে মুন্সী ইটভাটায় ব্রিকসে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু শিশু ভাটার বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এ সময় কথা হয় ইটভাটায় সজীব (১২) ও জামাল (১১) সঙ্গে। তারা জানায়, আট বছর বয়স থেকেই তারা ইটভাটায় কাজ করে আসছে। বর্তমানে কাজ করে সপ্তাহে ৩শ’ থেকে ৯শ’ টাকা পায় তারা। এ টাকা নিয়ে বাবার সংসারেই দেয় । লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় কি-না এমন প্রশ্ন করা হলেতারা জানায়, লেখাপড়া করতে মন চায় কিন্তু টাকা পাব কোথায়? লেখাপড়া করলে খামু কী?।

 

শ্রম আইন-২০০৬ এর ২৮৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।

 

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরক্ষা বিষয়ক ২৪টি ধারা রয়েছে। ধারা ৩২-এর ১-এ বলা আছে, শরীক রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রক্ষা করবে এবং শিশুর শিক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে।

 

এই শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এখনো দেশে এই সনদের বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুরা এখনো অরক্ষিত, এখনো গড়ে ওঠেনি আলাদা মন্ত্রণালয়।

 

আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার একেএম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ বলেন, যে সব ইটভাটায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।