জাতীয়

আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ওষুধ, ভেজালের উপদ্রবে অসহায় মানুষ

By admin

May 28, 2025

 

বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল ওষুধের কারবারিরা। শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল, সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ, যা নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

 

কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে ভেজাল ও নকলের উপদ্রব এতটাই বেড়েছে যে, চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে ওষুধগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ বন্ধও করে দিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।

 

 

তেমনই একটি ওষুধের নাম ‘অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন’, যা মূলত বড় ধরনের অস্ত্রপচার বা গুরুতর আঘাত পরবর্তী চিকিৎসায় রক্তে প্লাজমার পরিমাণ বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ওষুধটির নকল ও ভেজালে এখন বাজার সয়লাব বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

 

 

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, বাজারে এর নকল এতটাই বেড়ে গেছে যে, আমরা এটা দেওয়া প্রায় বন্ধই করে দিছি।

 

 

অ্যালবুমিন ব্যবহারের পরও বছরখানেক আগে সিলেটে এক রোগীর মৃত্যু এবং ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে রোগীর শরীরে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ইঞ্জেকশনটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপরেই নকলের বিষয়টি নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা।

 

 

তারা বলছেন, নকল অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশনটি দেখতে এতটাই আসলের মতো যে খালি চোখে দেখে সেই পার্থক্য ধরা যায় না।

 

 

 

ডা. চঞ্চল কুমার বলেন, সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবে, তারা অসহায় অবস্থায়। আমরা ডাক্তারারই তো অনেক সময় ধরতে পারি না যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। দেখতে একই রকম লাগে। সেজন্যই পারতপক্ষে ব্যবহার না করার চেষ্টা করি।

 

বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের। ঢাকার বাইরে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। অনেকক্ষেত্রে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি বিক্রির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য যে ধরনের তৎপরতা থাকা প্রয়োজন, সরকারের তরফে সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তারা।

 

 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এক্ষেত্রে আমরা সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। যার কারণে কঠোর আইন থাকার পরও বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য দেখা যাচ্ছে।

 

 

উল্লেখ্য যে, নকল ও ভেজাল ওষুধ ঠেকাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ২০২৩ সালে ওষুধ ও কসমেটিক আইন পাস করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর ওই আইনে এখন পর্যন্ত কাউকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার নজির নেই।

 

আটা-ময়দার ট্যাবলেট

বাংলাদেশে যেসব ওষুধের নকল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দা, এমনকি সুজি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।

ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের জেলা, সবখানেই আমরা এটা পেয়েছি। তবে ঢাকার বাইরে আটা-ময়দার এরকম নকল ওষুধ বেশি দেখা গেছে।

 

 

অতীতে পুলিশের হাতেও এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনকারীর ধরা পড়ার নজির আছে। ২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে আটা, ময়দা এবং সুজি ব্যবহার করে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী একটি দলের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে তখন বিভিন্ন ধরনের প্রায় পাঁচ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। দলটির সদস্যরা প্রায় দশ বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করে আসছিল বলে জানান পুলিশের কর্মকর্তারা।

 

 

গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, যেসব ওষুধের চাহিদা ও দাম বেশি, বাজারে সেসব ওষুধের নকল বেশি দেখা যাচ্ছে। চাহিদা থাকার পরও বাজারে সহজে পাওয়া যায় না, এমন ওষুধেরও নকল বের হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত ওষুধের পাশাপাশি অনেক বিদেশি ওষুধও নকল হতে দেখা যাচ্ছে।

 

 

 

গবেষক ও ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া জানান, যেহেতু চাহিদা রয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে, ফলে সহজে লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকেই একশ্রেণির মানুষ এসব ওষুধের নকল বের করছে।

 

 

নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন মাধ্যমে ওষুধগুলো পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকার অলিগলির ফার্মেসি থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদনে যেহেতু আসলের মতো খরচ হচ্ছে না, সেকারণে ওষুধগুলো কোম্পানির চেয়ে অনেক কম রেটে (দামে) ফার্মেসিগুলো পেয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশি লাভের আশায় তারাও এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় রোগীরাও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।

 

 

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, বিশেষ করে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তারাই দেখা যাচ্ছে এগুলো কিনছেন এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

 

 

বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির মধ্যে বড় একটা অংশেরই অনুমোদন নেই বলে জানা যাচ্ছে। আবার যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, নজরদারির অভাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক ফার্মেসি নিয়ম-নীতি মানছে না বলে জানিয়েছেন তারা।

 

 

ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, বিশেষ করে, মফস্বল শহর ও গ্রামে যে ফার্মেসিগুলো গড়ে উঠছে, সেগুলোর বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। ওষুধ সংরক্ষণের মতো পরিবেশও অনেকগুলোতে নেই। অথচ ওষুধ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের পরিবেশের প্রয়োজন হয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

তিনি আরো বলেন, ওষুধের গায়েই লেখা থাকে যে সেটি কেমন পরিবেশে এবং কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। সেজন্য ফার্মেসিতে এসি এবং ফ্রিজ রাখাটা জরুরি। কিন্তু আমরা তো দেখছি যে, ঢাকার বাইরে, এমনকি ঢাকার ভেতরেও অসংখ্য ফার্মেসিতে সেগুলো নেই।

 

সারা দেশে যেভাবে ছড়াচ্ছে

স্বাভাবিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি কম দেখা যায়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ বাহিনীকে আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসনকেও সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এই সুযোগে ভেজাল ওষুধ কারবারিরা সক্রিয় হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ঢাকায় ওষুধের বড় পাইকারি বাজার মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ঢাকা ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় নতুন করে নকল ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়েছে।

 

 

 

কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর- ওইসব এলাকায় কারখানা আছে বলে জানান এক ব্যবসায়ী। তবে ঠিক কারা এসব নকল ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ বিক্রেতাদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। যদিও মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে ওই এলাকার ব্যবসায়ী নেতাদেরও গ্রেপ্তার হওয়ার নজির আছে।

 

 

 

বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি কার্যালয়ের সচিব আবু হেলা মোস্তফা কামাল বলেন, কিন্তু এখন যতটুকু জানি, এগুলো অনেক কমে গেছে। তারপরও কেউ নকল ওষুধ বিক্রি করছে কি-না, সেটা বোঝা মুশকিল। ধরা না পড়া পর্যন্ত টের পাওয়া যায় না।

 

 

 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নকল ওষুধ বিক্রির ধরন এখন বদলে গেছে। তারা বলেন, আগে তো দেখা যেত সরাসরি মার্কেটে দিত। কিন্তু এখন বিক্রি করে অনলাইনে। আবার কুরিয়ারও করে পাঠায়। এভাবে সারা দেশে ছড়াচ্ছে।

 

 

অতীতে নকল ও ভেজাল ওষুধ কারকারিদের যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। নতুন চক্রটির ব্যাপারে তারা কী বলছেন? ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক সর্দার বলেন, আসলে নতুন চক্রটির ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখবো।