পদ্মাসেতু চালুর এক বছর: সুফল মিলছে জনজীবনে

প্রকাশিত: ৯:২০ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৫, ২০২৩

পদ্মাসেতু চালুর এক বছর: সুফল মিলছে জনজীবনে
নিউজটি শেয়ার করুন

 

পদ্মাসেতু চালুর একবছর পূর্ণ হলো। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় পদ্মাসেতু। সরকারের অন্যতম এই মেগা প্রকল্পটির কারণে এরইমধ্যে জনজীবনে সুফল দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

 

 

বিশাল এই জনপদের মানুষের জীবনে গতি এসেছে পদ্মাসেতুর কারণে। তারা অর্থনৈতিক মুক্তির আশা দেখছেন— এই সেতুকে ঘিরে। এই সেতু দিয়ে এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যানবাহন চলাচল করছে। পদ্মানদীতে আগে ফেরি থাকায় এসব জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ছিল ভোগান্তির। সেতু হওয়ায় সেই ভোগান্তি দূর হয়েছে।

 

 

জনপ্রতিনিধি থেকে সাধারণ মানুষ— সবাই এখন একবাক্যে বলছেন, স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাস্তব রূপলাভ করার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবনে সুফল মিলছে। বিভিন্ন জেলার সঙ্গে রাজধানী থেকে যাতায়াতের সময় কমেছে ৪-৫ ঘণ্টা, যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। এর ফলে যাত্রী পরিবহনে যেমন দ্রুতগতি যুক্ত হয়েছে, তেমনই পণ্য পরিবহনেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ কারণে যোগাযোগের পাশাপাশি তারা এখন অর্থনৈতিক মুক্তির আশা দেখছেন।

 

 

পদ্মাসেতু চালু হয় গত বছরের ঈদুল আজহার ঠিক আগ মুহূর্তে। গত বছরের কোরবানির ঈদ এবং চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের সময়— অর্থাৎ এই দুই ঈদযাত্রায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এবারের কোরবানির ঈদযাত্রায়ও স্বস্তি মিলবে। ফলে ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবন থেকে ফেরির দীর্ঘ যানজট ও ভোগান্তি দূর হয়েছে। জনজীবনে এই সেতুর সুফলের কথা সবার মুখে মুখে।

 

 

সেই কথাই বলছিলেন বরিশালের মিনহাজ উদ্দিন, যিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বলেন, আগে প্রতিবার ঈদের সময় নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হতো। পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় সেই স্মৃতি এখন শুধুই অতীত। গত দুই ঈদযাত্রায় স্বস্তিতে বাড়ি গিয়েছি। এবার ঈদযাত্রা নিয়েও কোনো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না। ফেরিতে গাড়ি পারাপারের কারণে আগে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হতো। ৮-১০ ঘণ্টা বসে থাকতে হতো গাড়িতে। এখন পদ্মাসেতু দিয়ে এক মুহূর্তে নদী পার হচ্ছি।

 

 

এ তো গেলো ঈদযাত্রার কথা। বছরের অন্যান্য সময়েও ২১ জেলার মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে সময় বেঁচে গেছে ৪-৫ ঘণ্টা। সেতুর সুফল পাচ্ছে বরিশাল, খুলনা বিভাগসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। যাত্রাপথে সময় বেঁচে যাওয়ায় ভোগান্তি কমেছে। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে গাড়িভাড়াও কমেছে। উভয় ক্ষেত্রে যানবাহন বেড়েছে।

 

 

খুলনার শিহাবুল ইসলাম বলছিলেন, পদ্মাসেতুর কারণে রাজধানীতে বসবাস করা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত একেবারে সহজ হয়ে গেছে। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হয় না। আগে সকাল ও সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বাস ছাড়তো। এখন এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা পরপর বাস ছাড়ছে। বাসের টিকিট পেতেও সমস্যা হয় না। পরিবহনগুলো এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করছে। ফলে যাত্রীসেবাও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পদ্মাসেতু।

 

 

রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সুফল জনজীবনে স্বস্তি এনেছে। সময় বাঁচার পাশাপাশি অর্থের অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে, বিশেষ করে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। ফেরিতে যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় ঘাটে অপেক্ষমাণ থাকতো সারি সারি ট্রাক-পিকআপ। এখন টোলে ফেরির চেয়ে টাকা বেশি দিতে হলেও পণ্য পরিবহনের ভাড়া আগের চেয়ে কমেছে। আগে ঘাটে আটকে থাকার কারণে পচনশীল মালামাল নষ্ট হতো, এখন সেই শঙ্কা আর তাড়া করে না ব্যবসায়ীদের।

 

 

যশোরের সবজি ব্যবসায়ী বদিরুল আলম চৌধুরী বলেন, তার এলাকায় উৎপাদিত সবজি ট্রাকভর্তি করে ঢাকায় পাঠাতে ফেরিতে ৪-৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক সজবি নষ্ট হতো। ট্রাক ভাড়াও বেশি গুণতে হতো। এখন পদ্মাসেতু দিয়ে পণ্য পাঠানোর কারণে খরচ কমে গেছে, সবজিও তাজা থাকছে। যেকোনো সময় কাঁচামাল ভর্তি ট্রাক রাজধানীতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে আমার মতো অন্য ব্যবসায়ীরাও লাভবান হয়েছে।

 

 

 

পদ্মাসেতু উদ্বোধনের সময় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আজকে আপনারা নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। আমরা রাস্তাঘাট-ব্রিজ করেছি। সবার জন্য যোগাযোগ হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের দোয়ারিকা, শিকারপুর, গাবখান থেকে শুরু করে পয়সা পর্যন্ত সেতু বানিয়ে দিয়েছি। যাতে এ এলাকার মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।

 

 

 

সড়কের পাশাপাশি রেলপথ চালু হবে দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মাসেতুতে। সেতুর নিচে রেল এবং ওপরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে একটি বিশেষ ট্রেন পদ্মাসেতু অতিক্রম করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৬২১ নম্বর ইঞ্জিন পরিচালিত ৫টি বগি-বিশিষ্ট ট্রেনটি ভাঙ্গা স্টেশন থেকে ৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মাসেতু পার হয়ে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছায়। ঐদিন মাদারীপুর, শরীয়তপুর এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলে। ট্রেনের গতি ছিলে ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার।

 

 

 

গত ২৩ জুন রেল সচিব হুমায়ন কবির যশোরের শার্শার বেনাপোল রেল স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে জানান, ২০২৪ সালের মধ্যে পদ্মাসেতু হয়ে বেনাপোল-ঢাকা রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে। বেনাপোল রেল স্টেশনকে আরো আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা হবে। পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে যাত্রী বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। বহিরাগতরা যাতে স্টেশন এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

 

 

 

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে পদ্মাসেতু। এই সেতু ঘিরেই সোনালী ভবিষ্যতের আশা দেখছেন— এই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরো মনোযোগ কেড়েছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হাতছানি দিচ্ছে।

 

 

 

সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পদ্মাসেতু নির্মাণ করায় এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। শিল্প কলকারাখানা হবে। আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারবো। দেশে-বিদেশে রফতানি করতে পারবো। আমাদের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশে-বিদেশে রফতানি করতে পারবো। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। অনন্ত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। সেটা আমরা করতে পারবো। এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে।

 

 

 

পদ্মাসেতু চালুর ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। পদ্মাসেতু নির্মাণের পর পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বেড়েছে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মাসেতুর মাধ্যমে এই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হওয়ার হাতছানি দিচ্ছে।

 

 

 

খুলনা-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মো. মিজানুর রহমান মিজান বলেন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ বেড়েছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। পদ্মাসেতুকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলায় নানারকম শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এই অঞ্চলে এরইমধ্যেই গড়ে উঠেছে। নতুন করে জুট মিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরইমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা হয়েছে, ইপিজেড করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। পদ্মাসেতুর পাশাপাশি গ্যাস আর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো গেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে শিল্পের নগরী।

 

 

 

পদ্মাসেতুর সুফল পাওয়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা হচ্ছে— খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।


নিউজটি শেয়ার করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ