ঢাকা ১লা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৪৪ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২২
আগামী ২৫ জুন জমকালো আয়োজনে উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর উদ্বোধন করবেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে আনন্দ উদ্দিপনার কমতি নেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে। তবে হাসি নেই বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটের লঞ্চ মালিক এবং শ্রমিকদের মুখে। পদ্মা সেতু নৌ রুটের লঞ্চগুলোতে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তবে পদ্মা সেতু বরিশাল অঞ্চলের লঞ্চ যাত্রীদের জিম্মিদশা থেকে রক্ষা করবে বলে মনে করছেন যাত্রীরা।
জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠির বিশাল একটি অংশের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। লেখা-পড়া আর বিভিন্ন কল-কারখানায় চাকরির সুবাধে ঢাকায় বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে প্রায়শই বরিশাল-ঢাকা আসা যাওয়া করতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। আবার অফিসিয়াল এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য ঢাকা-বরিশাল যাত্রা করতে হয় অসংখ্য মানুষকে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসব মানুষের প্রথম পছন্দ নৌ-রুট। লঞ্চের কেবিনে রাতভর ঘুমিয়ে থেকে সকালে উঠে ঢাকা সদরঘাটে পৌঁছে কাজ শেষ করে আবার গন্তব্যে পৌঁছাতে লঞ্চে উঠেন তারা। তবে ভ্রমন আনন্দদায়ক হলেও আসা যাওয়ায় সময় লেগে যাচ্ছে অন্ততঃ তিন দিন। তার ওপর লঞ্চে যাত্রী সেবার মান এবং রোটেশন প্রথার কারণে কেবিনের টিকেট নিয়ে জিম্মি হয়ে পড়েন যাত্রীরা।
তার পরেও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু বড় প্রতিবন্ধকতার কারণে জনপ্রিয় হয় নদীপথ। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে শুরু হয় বিলাশবহুল যাত্রীবাহী লঞ্চ তৈরির প্রতিযোগিতা। সুরভী, সুন্দরবন, মানামী, কীর্তনখোলা, কুয়াকাটা এবং প্রিন্স আওলাদের মতো সুসজ্জিত মনোরম পরিবেশে বাংলার টাইটানিক খ্যাত বিলাশবহুল লঞ্চ চলাচল করছে বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে।
বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক মো. কবির হোসেন বলেন, ‘বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে কাগজে কলমে ২১টি লঞ্চ চলাচল করছে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ১৪টি বিলাশবহুল লঞ্চ। এর মধ্যে বরগুনা-তুষখালী-ঢাকা রুটের ৭টি লঞ্চ বরিশাল ভায়া হয়ে চলাচল করছে। বরিশাল থেকে একটি লঞ্চ চলছে দিবা সার্ভিসে। এছাড়া প্রতিদিন অন্তত ৬টি করে নৌযান চলাচল করছে বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে। বাকি লঞ্চগুলোর সময় সূচি থাকলেও যাত্রী সংকটের কারণে সেগুলো চলাচল করছে না। তার ওপর পদ্মা সেতু চালুর পরে বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটের লঞ্চে যাত্রীর সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটের এমভি সুন্দরবন-১২ লঞ্চের ঘাট সুপারভাইজার মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে নৌরুটে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমরা মনে করছি। কেননা পদ্মা সেতু চালু হলে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় মানুষ ঢাকায় যেতে পারবে। আবার কাজ শেষে ওই দিনই বরিশালে ফিরতে পারবেন।
তিনি বলেন, ‘লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া এখন ১৪শত টাকা। অথচ বাসে গেলে ৭-৮শ টাকার মধ্যে যেতে পারছে। ডাবল কেবিনের ভাড়া ২৮শত টাকা। সেখানে বাসে গেলে লাগবে সর্বচ্চ ১৬শ টাকা। যে কারণে পদ্মা সেতু চালুর পরে কেবিনের যাত্রী সংখ্যা কমে যাবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু উদ্বোধন পরবর্তী ছয় মাস থেকে এক বছর বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে লঞ্চ মালিকদের। কেননা এই একবছরে অধিকাংশ মানুষ পদ্মা সেতু ভ্রমনের জন্য সড়ক পথে যাত্রা করবেন।
মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের এক একটি লঞ্চে সকল শ্রেডু মিলিয়ে অন্ততঃ ৫০ জন করে স্টাফ রয়েছেন। যাদের উপার্জনের একমাত্র পথ। লঞ্চে চাকরি করেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পরে যাত্রী সংখ্যা কমে গেলে মালিকরা ভিন্ন পথ খুঁজবে। এ ক্ষেত্রে অনেক স্টাফের চাকরিও চলে যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব লঞ্চের জনপ্রিয়তা নেই সেইসব লঞ্চ যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা মিলন বিশ্বাসের।
এদিকে, পদ্মা সেতু লঞ্চ ব্যবসায় কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে তা পরিবহনের ভাড়ার ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন ও লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল অঞ্চলের সভাপতি শেখ আবুল হাসেন। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে যেপরিমাণ টোল নির্ধারণ হয়েছে তাতে পরিবহনের ভাড়া বাড়বেই। তাছাড়া সড়ক পথের যাত্রা কতটা নিরাপদ সেটা দুর্ঘটনার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আবার পরিবহনের ভাড়া যদি লঞ্চের সমান বা সামান্য ব্যবধান হয় তবে নৌ পথে যাত্রী কমবে না। তবে ব্যবধানটা যদি বেশি হয় সে ক্ষেত্রে নৌ রুটে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে লঞ্চের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি লঞ্চ মালিকদের ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা (যাপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন পরবর্তী লঞ্চ শিল্পে প্রভাব পড়বে কিনা তা নিয়ে চিন্তাতো কিছু আছেই। তবে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে না। কারণ সড়ক পথের তুলনায় লঞ্চের ভাড়া কম। নৌ ভ্রমন নিরাপদ, আরাম দায়ক এবং সাশ্রয়ী। সড়ক পথে মালামাল পরিবহনে খরচ ১০ টাকা হলে সেখানে আমাদের লঞ্চে খরচ মাত্র ৩-৪ টাকা। সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১০০০ থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত। তাছাড়া ডেক শ্রেণিতে মানুষ দুই থেকে তিনশত টাকায় ভ্রমন করতে পারবে। যা সড়ক পথে হবে না।
তাছাড়া বরিশাল অঞ্চলের মানুষ বাসের থেকে লঞ্চ ভ্রমনে আরামদায়ক মনে করে। তারা লঞ্চ ভ্রমনে অভ্যস্ত। একজন লোক পরিবার নিয়ে কষ্ট করে সড়ক পথে ভ্রমন করতে চায় না। সেখানে লঞ্চে পরিবার নিয়ে লঞ্চ ভ্রমন অনেক আনন্দদায়ক। যে কারণে আমারা মনে করছি পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে লঞ্চ শিল্পে অতটা প্রভাব ফেলতে পারবে না। এজন্য সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে নৌপথ খনন করে সচল এবং নিরাপদ রাখার জন্য।
তবে অপর এক প্রশ্নের জবাবে লঞ্চ মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘আমি পদ্মা সেতুর বিপক্ষে না। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্র হবে, নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। মানুষের পদচারণা বেড়ে যাবে। আরিচায় সেতু না করে টানেল করবে। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি হিসেবে আমার দাবি কুয়াকাটা পর্যন্ত রাস্তা প্রসস্ত হোক, ফোরলেন সড়ক করা হোক।
তবে লঞ্চও একটা শিল্প। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কেননা পদ্মা সেতুর কারণে যদি প্রভাব পড়েই তবে আমাদের বিলাশবহুল লঞ্চগুলো অন্য কোন রুটে সরিয়ে নেয়ার উপায় থাকবে না। আমাদের লঞ্চ মালিকদের অনেক কষ্ট হবে। কেননা এখন সকল থাকা পর্যায়ে লঞ্চ আছে। ঢাকা থেকে প্রতিটি রুটেই লঞ্চ চলছে। সরকার আমাদের কিছুটা ট্যাক্স কমিয়ে দিলে লঞ্চ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে যোগ করেন লঞ্চ মালিক সমিতির এই নেতা।
Design & Developed By ইঞ্জিনিয়ার বিডি নেটওয়ার্ক